ভাদ্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে পালিত হয় রাধাষ্টমী। শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর ঠিক অষ্টম দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীরাধা। তাই কৃষ্ণ জন্মের পরের অষ্টমীই হয়ে ওঠে রাধার জন্মোৎসব। বৈষ্ণব সমাজে এই দিনটির মাহাত্ম্য অপরিসীম। কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি ভক্তির শীর্ষ প্রকাশ, প্রেমের পরম ব্যাখ্যা এবং সংসার জীবনের শুভাশীষের দিন হিসেবে পূজিত হয়।
রাধাষ্টমী রাধা—কৃষ্ণপ্রেমের চিরন্তন প্রতীক Radha Ashtami iskcon
শ্রীরাধা হলেন কৃষ্ণপ্রেমের সেই অবিনশ্বর প্রতীক, যাঁর নাম উচ্চারণ করলেই ভক্ত হৃদয়ে জাগে অশেষ আনন্দ। কৃষ্ণ লীলার সমস্ত কাহিনীর কেন্দ্রে যে মহাশক্তি প্রবাহিত, তিনি রাধা। বলা হয়, কৃষ্ণ ভগবানের পরিপূর্ণতা রাধার সঙ্গেই ফুটে ওঠে। রাধা ছাড়া কৃষ্ণ অসম্পূর্ণ। এই কারণেই ভক্তরা বলে থাকেন—”রাধাকৃষ্ণ”। কৃষ্ণের আগে রাধার নাম উচ্চারণ করাটাই ভক্তির প্রকৃত শুদ্ধতা।
জন্মকাহিনীর আধ্যাত্মিকতা রাধাষ্টমী Radha Ashtami iskcon
বরসানার রাজা বৃষভানু ও রানি কীর্তিদেবীর গৃহে রাধার আবির্ভাব হলেও, তাঁর জন্মকাহিনীতে লুকিয়ে আছে অতীন্দ্রিয় সত্য। গোলোকধামে কৃষ্ণ ও রাধার সম্পর্ক ছিল অনন্ত, অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সুদামার অভিশাপে রাধাকে মর্ত্যে জন্ম নিতে হয়। একদিকে শঙ্খচূড় রাক্ষসের জন্ম, অন্যদিকে রাধার অবতরণ—এই দুই ঘটনা একসঙ্গে কৃষ্ণলীলার পথ প্রশস্ত করেছিল। ফলে ভক্তদের কাছে রাধার জন্ম শুধুমাত্র পার্থিব কোনো ঘটনা নয়, বরং ভগবানের এক সুপরিকল্পিত লীলার অংশ।
ব্রতের মাহাত্ম্য
রাধাষ্টমীর ব্রত পালন করলে জন্ম জন্মান্তরের পাপক্ষয় হয় বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই ব্রতের ফলাফল লক্ষাধিক একাদশী ব্রতের সমান। আবার অনেকে বলেন, এক পর্বত পরিমাণ সোনাদান করার যে পুণ্যফল, তার সমান ফল লাভ হয় রাধাষ্টমী পালন করলে। তাই এটি শুধু একটি আচার নয়, ভক্তের আত্মার পরিশুদ্ধির এক মহৎ উপায়।
প্রেম ও ভক্তির একীকরণ
রাধা কেবল কৃষ্ণের সঙ্গিনী নন, তিনি প্রেমের মূর্ত প্রতীক। তাঁর ভক্তি ছিল নিঃস্বার্থ, নিরঙ্কুশ, অবিচল। কৃষ্ণকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা
রাধাষ্টমী কেবল ক্যালেন্ডারের একটি দিন নয়। এটি এক চেতনার জাগরণ, যেখানে প্রেম আর ভক্তি একাকার হয়ে যায়। যখন আমরা রাধাষ্টমীর কথা বলি, তখন মূলত ভক্তির সর্বোচ্চ অবস্থাকে বুঝি। ভগবানকে পাওয়া যায় জ্ঞানের মাধ্যমে, যোগের মাধ্যমে, বা ত্যাগের মাধ্যমে—এই ধারণা বহু শাস্ত্রে আছে। কিন্তু রাধা দেখালেন, ভগবানকে পাওয়া যায় প্রেমের মাধ্যমে, সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
রাধার জন্মকথা শোনার পর মনে হয়, তাঁর পৃথিবীতে আগমন যেন কেবল মানবজীবনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সংসার যখন অশান্তিতে ভরে যায়, তখন রাধা মনে করিয়ে দেন—সত্যিকারের প্রেম মানে অধিকার নয়, বরং নিঃশর্ত দান।
আমরা জীবনে অনেক সময় ভালোবাসাকে হিসেব করি। কতটা পেলাম, কতটা দিলাম—এই মাপকাঠি দিয়ে বিচার করি। কিন্তু রাধার ভক্তি শেখায়, ভালোবাসার কোনো হিসেব হয় না। রাধা কৃষ্ণকে চেয়েছিলেন, কিন্তু দাবি করেননি। তাঁর ভালোবাসা এতটাই বিশুদ্ধ ছিল যে কৃষ্ণ নিজেও সেই প্রেমের কাছে নত হয়েছিলেন।
রাধাষ্টমী তাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সম্পর্কের আসল শক্তি হলো ত্যাগ। স্বামী-স্ত্রী হোক, বন্ধু হোক, কিংবা সমাজের মানুষজনের প্রতি—সবার সাথে সম্পর্ক টিকে থাকে যদি ভেতরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকে। রাধার প্রেম এই সত্যকে চিরন্তন করেছে।
আরেকটি ভাবনা আসে রাধার অভিশাপ প্রসঙ্গে। সুদামার সঙ্গে তাঁর বিরোধ, সেই রাগ, অভিশাপ—সব মিলিয়ে বোঝা যায়, দেবতাদের মধ্যেও কখনো কখনো মানবীয় আবেগ থাকে। কিন্তু সেই আবেগও শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের লীলায় মিশে যায়। এখানেই এক শিক্ষা—আমাদের জীবনে রাগ, দুঃখ, অভিমান থাকতেই পারে। কিন্তু যদি বিশ্বাস থাকে যে সবকিছু ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে, তাহলে সেই কষ্টও একদিন আশীর্বাদে পরিণত হয়।
রাধাষ্টমী আমাদের সংসার জীবনের জন্যও গভীর বার্তা দেয়। বলা হয়, এই ব্রত করলে সংসারে সুখ-শান্তি আসে। কেন আসে? কারণ রাধার প্রেম আমাদের শেখায় কিভাবে দাম্পত্য সম্পর্ককে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়। দাম্পত্য মানে শুধু দায়িত্ব নয়, মানে পরস্পরের প্রতি অবিচল ভক্তি। যে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই রাধাসুলভ প্রেম থাকে, সেখানে অশান্তি থাকতে পারে না।
আধ্যাত্মিক দিক থেকেও রাধাষ্টমী বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে রাধা ছিলেন অনন্য প্রতীক। চৈতন্য মহাপ্রভু থেকে শুরু করে অসংখ্য সাধক রাধাকে দেখেছেন ভক্তির সর্বোচ্চ শিখর হিসেবে। কৃষ্ণ ভগবান হলেও, রাধা ভক্তির সেই শক্তি যা কৃষ্ণকে হৃদয়ে নামিয়ে আনে। ভাবতে অবাক লাগে—ভক্তের শক্তিই ভগবানকে আবদ্ধ করতে পারে।
আজকের যুগে, যখন মানুষের মনে ভোগবিলাস, প্রতিযোগিতা আর স্বার্থপরতা বেড়েছে, তখন রাধাষ্টমী আমাদের শিখিয়ে দেয়—সবচেয়ে বড় শক্তি হলো নিঃস্বার্থ প্রেম। সমাজে যদি এই প্রেম প্রবাহিত হয়, তাহলে বিরোধ, হিংসা, ঈর্ষা—সব মিলিয়ে যাবে।
একটি গভীর চিন্তার জায়গা আছে—রাধার নাম কৃষ্ণের আগে উচ্চারণ করা হয়। “রাধাকৃষ্ণ”। কেন? কারণ ভক্তির দরজা দিয়ে তবেই ভগবানের কাছে পৌঁছনো যায়। রাধা সেই দরজা। যে হৃদয়ে ভক্তি নেই, সেখানে কৃষ্ণও ধরা দেন না। এ যেন বোঝায়, ভক্তি ছাড়া জ্ঞান বা যোগ কিছুই পূর্ণতা পায় না।
রাধাষ্টমীর দিনে মানুষ যে ব্রত পালন করে, তার মূল উদ্দেশ্য কেবল পুণ্য লাভ নয়। প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করা। যখন কেউ রাধার কাহিনী শোনে, তখন তাঁর মনে প্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়। এই প্রেম পার্থিব কোনো সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি সর্বজনীন প্রেম, যা মানুষকে মানুষে যুক্ত করে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যদি এই ব্রতের শিক্ষা প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে জীবনের সমস্যাগুলো সহজেই মিটে যেতে পারে। অফিসে, পরিবারে বা সমাজে—যেখানেই থাকি না কেন, যদি আমরা রাধার মতো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শিখি, তবে সম্পর্কের জটিলতা অনেকটাই কমে যাবে।
আরেকটি ভাবনা আসে—রাধার জন্মকে বলা হয় “অবতার”। অর্থাৎ তিনি নিজে দেবী শক্তির অংশ। তাহলে তাঁর প্রেমও সাধারণ প্রেম নয়, এটি এক মহাশক্তি। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, রাধার প্রেমে যে ভক্ত ডুবে যায়, তার মনে আর কোনো আসক্তি থাকে না। জীবনের সমস্ত ভোগলিপ্সা ক্ষয় হয়ে যায়। এই প্রেমই মুক্তির পথ খুলে দেয়।
যখন আমরা রাধার গল্প শুনি, তখন মনে হয়—এ গল্প শুধু পুরাণ নয়, এটি মানুষের অন্তরের গল্প। আমরা প্রত্যেকেই কোথাও না কোথাও কৃষ্ণকে খুঁজি। সেই কৃষ্ণ হয়তো সত্য, শান্তি, কিংবা ভালোবাসার প্রতীক। আর সেই কৃষ্ণের পথে আমাদের হাত ধরে নিয়ে যান রাধা।
সামাজিকভাবে রাধাষ্টমীর আরও একটি তাৎপর্য আছে। উৎসব মানে মিলন, মানে একসাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। রাধার জন্মোৎসব মানুষকে একত্রিত করে, ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়। যে গ্রামে, যে শহরে রাধাষ্টমী পালিত হয়, সেখানকার মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও এক সুরে বাঁধা পড়ে যায়।
সবশেষে বলা যায়, রাধাষ্টমী কেবল একটি ব্রত নয়। এটি এক গভীর দর্শন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাধার শিক্ষা কার্যকর। প্রেমকে নিঃস্বার্থ করো, ভক্তিকে আত্মসমর্পণে পরিণত করো, সংসারকে ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলো, আর বিশ্বাস রাখো যে প্রতিটি ঘটনার পেছনে ঈশ্বরের লীলা লুকিয়ে আছে। এই ভাবনায় জীবন যাপন করলে দুঃখ কষ্ট থাকলেও মন থাকবে শান্তিতে, আর সম্পর্ক থাকবে অটুট।