দুর্গাপূজায় পতিতালয়ের মাটি কেন লাগে?

দুর্গাপূজায় পতিতালয়ের মাটি কেন লাগে? দুর্গাপূজায় পতিতালয়ের মাটি কেন লাগে?

দুর্গাপুজো মানেই বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব, কিন্তু এর অন্তরালে কত অনুচ্চারিত কাহিনি, কত অজানা দার্শনিকতা লুকিয়ে আছে—তা অনেকেই জানেন না। তার মধ্যেই একটি অদ্ভুত অথচ গভীর বিষয় হল পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার। সমাজ যাদের প্রান্তিক করে রেখেছে, সেই নারীদের অস্তিত্বই আসলে এই উৎসবকে পূর্ণতা দেয়।

সমাজের তৈরি ‘অশুদ্ধতা’ আর শাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি: দুর্গাপূজায় পতিতালয়ের মাটি কেন লাগে?

সমাজ একদম স্পষ্ট বিভাজন তৈরি করেছে—শুচি আর অশুচি। পতিতাদের জায়গা সেই অশুচি বলয়ে। অথচ ধর্মশাস্ত্রই বলছে, দেবীমূর্তি গড়তে তাদের ঘরের সামান্য মাটি ব্যবহার না করলে পূজা অসম্পূর্ণ। এর মধ্যে একরকম বিরাট দার্শনিক বিপরীততা আছে। সমাজ যাদের নিচু চোখে দেখে, দেবী তাঁদের আশ্রয় দিয়ে জানান—সবাই সমান।

আমরা ভেবে দেখলে অবাক হই। একদিকে পতিতাপল্লি সামাজিক লজ্জার প্রতীক, অন্যদিকে সেই মাটিই হয়ে ওঠে মহিষাসুরমর্দিনীর পায়ের তলা। দেবীকে শুদ্ধ করার জন্য এই মাটির প্রয়োজনীয়তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—অশুচি বলে কিছু নেই, সবকিছু মিলিয়েই সৃষ্টি হয় পূর্ণতা।

পুরুষের পাপ আর নারীর পুণ্য

ধারণা করা হয়, পতিতাদের ঘরে যারা যায়, তারা আসলে নিজেদের পুণ্য ফেলে রেখে আসে। সেই মাটি তাই বহু মানুষের ত্যাগ, বেদনা আর অনিচ্ছাকৃত পরিশুদ্ধির প্রতীক হয়ে ওঠে। যদি ভেবে দেখা যায়, পতিতারাই সমাজের পাপ নিজের শরীরে বহন করছে, যাতে বাকিরা ‘পবিত্র’ থাকতে পারে। এ এক কঠিন সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র

অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, দেবী সেই মাটিকেই বেছে নেন। হয়তো তিনি বলতে চান—যেখানে পাপ জমা হয়, সেখানেও শক্তি আছে, সেখানেও আশা আছে। সেই মাটিই হয়ে ওঠে শক্তির প্রতীক।

পৌরাণিক কাহিনির প্রতিফলন

বিশ্বামিত্র ও মেনকার গল্প হোক কিংবা নবকন্যার পূজা—সবেতেই এক সাধারণ বার্তা লুকোনো আছে। সতীত্ব বা সামাজিক মর্যাদা নয়, নারীত্বের শক্তিই আসল। পতিতালয়ের মেয়েরা সতী নয়, তবু তাঁরা দেবীর প্রতীক। কারণ তাঁরা ভোগ করেন, সহ্য করেন, তবু বেঁচে থাকেন। দেবী যেন তাঁদের মাধ্যমে দেখান—নারী মানে কেবল একরকম ছাঁচ নয়।

এক নীরব বিপ্লব

প্রতিবার ঠাকুরদালানে যখন মূর্তি গড়া হয়, কেউ উচ্চস্বরে ঘোষণা করে না—“এ মূর্তিতে পতিতালয়ের মাটি আছে।” তবু সেই অশ্রুত কণ্ঠই আসলে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। সমাজ যেখানে পতিতাদের নাম উচ্চারণ করতেও কুণ্ঠিত, সেখানে তাঁদের মাটিই হয়ে ওঠে পূজার কেন্দ্র। এটা এক নিঃশব্দ সামাজিক বিপ্লব

সমাজের দ্বিচারিতা

যারা দিনের আলোয় মুখ ফিরিয়ে নেয়, রাতের অন্ধকারে তারাই ভিড় জমায় সেই ঘরে। সমাজ পুরুষকে কখনও দায়ী করে না, সব দোষ চাপিয়ে দেয় মেয়েদের ঘাড়ে। অথচ পুরুষের আনন্দলিপ্সাই তো এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। তবু, আশ্চর্যভাবে, দেবী নারীর পক্ষেই দাঁড়ান। পতিতাদের ঘর থেকেই তিনি নিজের শক্তির উৎস খুঁজে নেন।

পতিতারা—শুধু ‘অশুচি নারী’ নয়

যে মাটিকে আমরা অশুচি বলি, সেটি আসলে অসংখ্য অশ্রু, অপমান, প্রতারণা আর সহিষ্ণুতার দলিল। সেই মাটিতে জমা আছে রক্ত-মাংসের বেদনা, আবার বেঁচে থাকার অনন্ত ইচ্ছাশক্তিও। দেবী তাই সেটিকেই বেছে নেন—কারণ শক্তি শুধু সুখের নয়, কষ্টেরও প্রতীক।

ধর্মের সামাজিক শিক্ষা

এখানে আসল শিক্ষা হল—মানুষকে ভাগ করে দেখা চলবে না। পতিতারা সমাজের বাইরের কেউ নয়, তাঁরাও দেবীর সন্তান। দেবীমূর্তিতে তাঁদের অংশগ্রহণ আমাদের শিখিয়ে দেয়, ধর্ম কখনও বৈষম্য শেখায় না, বরং সমতা আনে

উৎসবের ভেতরে আড়ালের কণ্ঠ

দুর্গাপুজো আমাদের কাছে আনন্দের সময়, কিন্তু মাটির এই রহস্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সব আনন্দের আড়ালে বেদনার অংশও জড়িয়ে আছে। প্রতিটি ঢাকের তালে, প্রতিটি ধুনুচির ধোঁয়ায় যেন ভেসে আসে সেই মেয়েদের নীরব কান্না। তবু তাঁদের অস্তিত্বই পূজোকে সম্পূর্ণ করে।

নারীশক্তির আসল রূপ

মহিষাসুরমর্দিনী মানেই শক্তি, সাহস আর প্রতিবাদের প্রতীক। পতিতারাও সমাজের বিরুদ্ধে একরকম প্রতিবাদ করেই বেঁচে আছেন। তারা হয়তো বেছে নেয়নি এই পথ, কিন্তু নিয়তির হাতে পড়েও তাঁরা হাল ছাড়েনি। তাই দেবী যেন তাঁদের সঙ্গেই নিজের শক্তি ভাগ করে নেন।

আমাদের দায়

আজও আমরা অনেক সময় এই কাহিনি জানলেও চোখ বুজে থাকি। উৎসবের আনন্দে ডুবে গিয়ে ভাবিই না, কতটা অন্যায় করে রেখেছি সমাজের এক বড় অংশের প্রতি। অথচ তাঁদের ছাড়া পুজোই অসম্পূর্ণ। তাহলে প্রশ্ন ওঠে—আমরা সত্যিই কি দেবীকে পূজা করি, নাকি কেবল তাঁর আড়ম্বরকেই?

দুর্গাপুজোর প্রতিটি মূর্তিতে পতিতালয়ের মাটির উপস্থিতি আসলে সমতার বার্তা। এটি প্রমাণ করে, দেবী সব নারীর, সব মানুষের। সমাজ যতই ছোট বা হেয় করুক, ঈশ্বর তাঁদের জায়গা দেন নিজের পায়ের তলায়। এই উপলব্ধিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা—
অশুচি বলে কিছু নেই, সবকিছু মিলিয়েই সৃষ্টি হয় সত্যিকারের পবিত্রতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *