দুর্গাপুজোর যে রূপ আমরা আজ দেখি, তা নিছক একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং বহুমাত্রিক সংস্কৃতির এক অনন্য প্রকাশ। সেই প্রকাশের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় ও গভীর তাৎপর্য বহন করে নবপত্রিকা পূজা। কেউ একে “কলাবউ” বলে, কেউ আবার “দেবীর প্রতীক” হিসেবে মানেন। কিন্তু আমাদের কাছে নবপত্রিকা মানে কেবল নয়টি গাছের একত্র সংযোগ নয়, বরং প্রকৃতি, কৃষি, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের এক সমন্বিত রূপ।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধনআমাদের প্রথম ভাবনাটা আসে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে। নবপত্রিকার প্রতিটি গাছের নির্বাচনই প্রমাণ করে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে দেবত্ব দিয়েছিলেন। আমরা জানি, মানুষের জীবন গাছপালা ছাড়া অসম্পূর্ণ। কলাগাছ হোক বা ধানের চারা—সবই আমাদের অন্ন, আশ্রয়, স্বাস্থ্য ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই দুর্গাপুজোর মতো মহোৎসবে এই গাছগুলিকে দেবীর প্রতীক বানানো নিছক কাকতালীয় নয়, বরং প্রকৃতির শক্তিকে দেবীর রূপে আরাধনার মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে চেয়েছে।
দেবী আর প্রকৃতির অভিন্নতাআমাদের মনে হয়, নবপত্রিকা পূজার সবচেয়ে বড় তাৎপর্য এখানেই—দেবী মানে কেবল মূর্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, তিনি প্রকৃতির ভেতরেই বিরাজমান।যদি আমরা খেয়াল করি, দুর্গা হলেন শক্তি, কিন্তু শক্তি তো শুধু যুদ্ধজয়ের মধ্যেই সীমিত নয়। শস্য দান, রোগপ্রতিরোধ, দুঃখ দূর করা, সমৃদ্ধি আনা—এসবই শক্তির প্রকাশ। আর এই শক্তিরই প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে গাছগুলো। ফলে গাছগুলোকে শুধু পুজোর অংশ বলা ভুল, আসলে তারা হল জীবন্ত শক্তির উৎস, যাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই নবপত্রিকা পূজা।কৃষিজীবনের সঙ্গে সংযোগআমাদের দ্বিতীয় চিন্তা ঘোরে কৃষি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দিকে। বাংলার দুর্গাপুজো কখন হয়? শরৎকালে—যখন ধান পাকার মুখে।
কৃষকের জীবনে তখন নতুন আশার আলো। তাই ধানের চারা নবপত্রিকায় স্থান পেয়েছে। একইসঙ্গে হলুদ, কচু, ডালিম—এসবই গ্রামীণ জীবনের নিত্যব্যবহার্য উপাদান। আমাদের মনে হয়, নবপত্রিকা পূজা আসলে ছিল কৃষিজীবনের এক ফসলপূজা, যা কালের নিয়মে দেবীপূজার অংশ হয়ে যায়।এই রীতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্ম আর কৃষি একে অপরের থেকে আলাদা ছিল না। মানুষের উৎসব মানে শুধু আনন্দ নয়, বরং প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানানোও ছিল তার অংশ।‘কলাবউ’ প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবনাআমাদের সমাজে একটা মজার প্রচলন আছে—নবপত্রিকাকে অনেকে গণেশের স্ত্রী ভাবেন। যদিও গ্রন্থে কোথাও এর উল্লেখ নেই। কেন এই বিভ্রান্তি তৈরি হলো?
আমাদের মনে হয়, এর পেছনে কাজ করেছে মানুষের কল্পনাশক্তি। দেবদেবীর সম্পর্ককে যেমন পরিবারকেন্দ্রিকভাবে বোঝানো হয়, তেমনই এখানে কলাবউ-কে একধরনের “পরিবারের অংশ” হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। হয়তো এটা বিশ্বাসীদের কাছে পূজাকে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে।
তবে প্রকৃতপক্ষে নবপত্রিকা হল দেবীর শক্তির প্রতীক। তাই একে কেবলমাত্র “বউ” বলে চিহ্নিত করা আসল অর্থকে আড়াল করে দেয়।আধ্যাত্মিক দিকআরেকটা গভীর ভাবনা হলো—নবপত্রিকার পুজো আমাদের শেখায় ঐক্য। নয়টি ভিন্ন ভিন্ন গাছ—যাদের রূপ, গন্ধ, গুণ সব আলাদা—একত্র বাঁধা হয় একটি পাটিতে। এখানেই প্রতীকী শিক্ষা: বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য। দেবী কেবল এক রূপে সীমাবদ্ধ নন, তিনি নানা রূপে, নানা শক্তিতে বিদ্যমান।
এই ভাবনাটা আজকের সমাজের জন্যও প্রযোজ্য। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন মানুষ—সবাইকে যদি একসঙ্গে বাঁধা যায় সম্মানের বন্ধনে, তবেই প্রকৃত অর্থে দেবীর আরাধনা পূর্ণ হয়।শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রসঙ্গচণ্ডীতে নবপত্রিকা পূজার সরাসরি উল্লেখ নেই, তবে শরৎকালের মহাপূজার বর্ণনা আছে। এটা আমাদের ভাবায়—হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতিপূজা থেকেই ধীরে ধীরে দেবীপূজার দিকে এগিয়েছিলেন।
দেবী আসলে মানুষের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসের রূপায়ণ। একসময় মানুষ প্রকৃতিকে ভয় পেত, তাই পূজা করত। পরে সেই প্রকৃতিই দেবীর রূপ পেল। নবপত্রিকা পূজা তাই প্রমাণ করে, দেবী হলেন প্রকৃতিরই মহিমান্বিত রূপ।আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকেআজকের দিনে দাঁড়িয়ে নবপত্রিকা পূজা নতুন অর্থও বহন করে।
আমরা জানি, পরিবেশ দূষণ, বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন—এসব সমস্যা পৃথিবীকে গ্রাস করছে। নবপত্রিকা পূজা আমাদের শেখায়—প্রকৃতিকে দেবী ভেবে তার সুরক্ষা করা উচিত। শুধু মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালালেই দেবীর পূজা হয় না, প্রকৃতিকে রক্ষা করাই আসল পূজা।তাই আমরা মনে করি, নবপত্রিকার প্রতীকী অর্থ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাটা জরুরি। যেন তারা বোঝে, কলাগাছ কাটলে দেবীর অপমান, বন ধ্বংস করলে শক্তির অপচয়।সমাজতাত্ত্বিক দিকআমাদের আরেকটি ভাবনা সমাজকে কেন্দ্র করে।
দুর্গাপুজো যেমন একতার উৎসব, তেমনই নবপত্রিকা পূজা গ্রামীণ মানুষকে যুক্ত করত এক অভিন্ন ধারায়। আগে গ্রামের মানুষ একসঙ্গে গাছ সংগ্রহ করত, স্নানের আচার করত, আর একসঙ্গে পুজো করত। এতে একটা সামাজিক বন্ধন তৈরি হতো। আজ যখন মানুষ ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছে, এই রীতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সমাজের শক্তি ঐক্যের মধ্যেই।
নারীত্বের প্রতীকনবপত্রিকার প্রতিটি গাছই একেকটি দেবীর রূপ। অর্থাৎ নারীশক্তির বহুমাত্রিক প্রকাশ। কখনও তিনি লক্ষ্মী হয়ে ধন দেন, কখনও চামুণ্ডা হয়ে অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করেন, কখনও শোকরহিতা হয়ে দুঃখ মুছে দেন। এই বৈচিত্র্য আসলে নারীশক্তির বহুমুখী দিকের প্রতীক। তাই নবপত্রিকা পূজা নারীশক্তিকে সম্মান জানাবারও এক আধ্যাত্মিক রূপ।আমাদের উপলব্ধিআমাদের কাছে নবপত্রিকা পূজা মানে একধরনের “জীবনদর্শন”। এই নয়টি গাছের মধ্যে লুকিয়ে আছে মানবজীবনের নয়টি দিকঅন্ন ধানস্বাস্থ্য হলুদসমৃদ্ধি ডালিমশান্তি অশোকপরিবার কলাশক্তি কচু, মানকচুভক্তি বেলজয়ের ইচ্ছা জয়ন্তীসব মিলিয়েই জীবন পূর্ণ হয়।
দেবী আমাদের শেখান, জীবনের প্রতিটি দিককেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।আমাদের মতে, নবপত্রিকা পূজা শুধু একটি আচার নয়, বরং এটি হল প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা, সমাজের ঐক্য, নারীশক্তির সম্মান এবং জীবনের বহুমুখী রূপকে উপলব্ধি করার এক মহামঞ্চ।আজকের দিনে আমরা যদি নবপত্রিকার প্রতীকী বার্তাকে সত্যিই গ্রহণ করি, তাহলে পরিবেশরক্ষা, সামাজিক ঐক্য আর মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার পথ অনেক সহজ হয়ে যাবে।