হিন্দু বিবাহব্যবস্থা: হিন্দু পুরুষ একাধিক বিবাহ করতে পারলেও নারী কেন পারে না? বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকার কোথায়?

হিন্দু বিবাহব্যবস্থা হিন্দু বিবাহব্যবস্থা

হিন্দু বিবাহব্যবস্থা: বিবাহ সংস্কার : প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি

বর্তমান যুগে বিবাহকে অনেকেই শুধু সামাজিক রীতি বা ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যম হিসেবে দেখে। কিন্তু অতীতের হিন্দু সমাজে বিবাহকে শুধুমাত্র দাম্পত্য জীবনের শুরু নয়, বরং একটি পবিত্র সংস্কার হিসেবে ধরা হতো। তখনকার মানুষ জানতো, পরিবারই হল জাতি ও সমাজের ভিত্তি।

যেমন ছোট ছোট বালুকণা ও জলের বিন্দু মিলে গড়ে ওঠে মহাদেশ ও সাগর, তেমনি কয়েকজন সদস্য মিলে গড়ে ওঠে একটি পরিবার, আর অসংখ্য পরিবার মিলে গড়ে ওঠে গোটা সমাজ। তাই পরিবারের সামান্যতম ভাঙনও সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য ঋষি-মুনিরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিবারপ্রধানের পাশাপাশি ব্রাহ্মণদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই ব্রাহ্মণ সমাজকে সঠিক পথনির্দেশ দিতেন, যাতে কেউ নিয়ম না জেনে ভুল পথে না যায়।

নারীর সম্মান : শাস্ত্রীয় নির্দেশ হিন্দু বিবাহব্যবস্থা

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হলেও, নারীর মর্যাদা কখনো ছোট করা হয়নি। মনুস্মৃতিতেই বলা আছে—

“যে স্থানে নারীদের সম্মান দেওয়া হয়, সেই স্থানেই দেবতারাও সন্তুষ্ট থাকেন। আর যেখানে নারীদের অবমাননা হয়, সেখানে সর্বনাশ ঘটে।” (মনুস্মৃতি ৩/৫৫-৫৭)

নারীকে শুধু সংসারের অঙ্গ নয়, বরং সংসারের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক বলা হয়েছে। যে পরিবারে স্ত্রী দুঃখী, সে পরিবার ধ্বংসের পথে যায়—এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। আবার ধর্মকর্ম, পূজা, উপবাস, যজ্ঞ—সব ক্ষেত্রেই স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে মিলেই চলতে হতো। অর্থাৎ বিবাহের পর নারী-পুরুষের দায়িত্ব ছিল যৌথ, একতরফা নয়।

বরের বাছাইয়ের শর্ত

শাস্ত্র বলছে, একজন সুপুরুষ কখনো নিজের স্ত্রীর জন্য ভুল কন্যা বেছে নেবে না। যেমন—

  • সপিণ্ড বা সগোত্রের মেয়ে নয়,
  • যাঁর পরিবারে অসুখ বা অভিশাপ আছে না,
  • যে ধর্ম মানে না, বা কু-অভ্যাসে জড়িত—তাঁকে স্ত্রী করা যাবে না।

একইভাবে কন্যা-দানের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে—

  • পিতা নিজের কন্যাকে অযোগ্য পুরুষের হাতে তুলে দেবেন না,
  • যদি বয়স হয়ে যায় এবং যোগ্য বর না মেলে, তবে কন্যা নিজেই স্বামী বেছে নিতে পারবে। (মনুস্মৃতি ৯/৮৮-৯১)

অর্থাৎ নারীর অধিকারও শাস্ত্র দ্বারা সংরক্ষিত ছিল।

একগামিতা বনাম বহুবিবাহ

শাস্ত্র অনুযায়ী আদর্শ ব্যবস্থা হলো এক পতি এক পত্নী
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র তাঁর জীবনে এই একগামীতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। মহাভারতের পাণ্ডুর ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় বিবাহ অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছিল, এবং পরে তিনি কুন্তীর কাছে ক্ষমাও চান।

অতএব বোঝা যায়, একগামী জীবনযাপনই ছিল মূলধারা, বহুবিবাহ ব্যতিক্রম।

বিবাহ-বিচ্ছেদ : শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি

হিন্দু বিবাহে যখন সপ্তপদী বচন নেওয়া হয়, তখন স্বামী-স্ত্রী আজীবন একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। এজন্য বিচ্ছেদকে ঘৃণিত মনে করা হতো।

মনুস্মৃতিতে বলা আছে—

“মৃত্যু অবধি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বস্ততা অব্যাহত থাকুক—এটাই সর্বোচ্চ আইন।” (মনুস্মৃতি ৯/১০১)

তবে বিচ্ছেদের অধিকার ছিল।

  • স্বামী যদি অসুস্থ, প্রতারক, বা কু-কর্মে লিপ্ত হন, স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করতে পারে। (মনুস্মৃতি ৯/৭২, ৯/৮২)
  • একইভাবে, স্ত্রী যদি কলঙ্কিত বা অসদাচারিণী হন, স্বামী তাঁকে ত্যাগ করতে পারে।
  • নারদ স্মৃতিতে বলা আছে, স্বামী কলঙ্কিত হলে স্ত্রীও তাঁকে ত্যাগ করে অন্যত্র যেতে পারে। (নারদ স্মৃতি ১২/৯৬)

অতএব, বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, তবে এটি ছিল অপ্রশংসিত।

পুনর্বিবাহ : বিধান ও সংস্কার

পুরুষের জন্য :

স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারতেন। মনুস্মৃতিতেই বলা আছে—

“স্ত্রী মৃত্যুর পর দ্বিজ পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারে এবং পঞ্চযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারে।” (মনুস্মৃতি ৫/১৬৭-১৬৯)

নারীর জন্য :

মনুস্মৃতিতে নারীর পুনর্বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা হলেও পরাশর সংহিতা বলছে—

  • স্বামী মারা গেলে,
  • সন্যাস নিলে,
  • অধার্মিক হলে বা অত্যাচারী হলে—
    নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারবে। (পরাশর সংহিতা ৪/২৬)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করে সমাজকে নতুন দিশা দেন। এর ফলেই অসংখ্য নারী নতুন জীবন ফিরে পায়।

বহুবিবাহ : পুরুষের জন্য অনুমোদিত, তবুও অপ্রশংসিত

ইতিহাসে কৃষ্ণ, চন্দ্রদেব প্রমুখের বহুবিবাহের উদাহরণ আছে। মনুস্মৃতি বলছে,

  • ব্রাহ্মণ সর্বোচ্চ ৪ বার,
  • ক্ষত্রিয় ৩ বার,
  • বৈশ্য ২ বার,
  • শূদ্র কেবল ১ বার বিবাহ করতে পারবে। (মনুস্মৃতি ৩/১২-১৩)

কিন্তু এ দ্বিতীয় বিবাহে সমাজের কোনো আশীর্বাদ থাকত না, সংস্কারও হতো না। ফলে বহুবিবাহকে মূলত সমাজ স্বীকৃতি দিত না

বহুভর্তৃকত্ব (এক স্ত্রী বহু স্বামী)

এই ব্যবস্থা ঘৃণিত হিসেবে গণ্য হয়েছে। ঋগ্বেদে এর উপস্থিতি থাকলেও, সমাজে নারীদের ভ্রষ্ট বলা হতো।

দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী গ্রহণ ছিল সংকট ধর্মের ফল। কুন্তীর ভুল নির্দেশ, দ্রৌপদীর পূর্ব জন্মের বর এবং দেশরক্ষার দায়—সব মিলিয়ে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়। তবে শাস্ত্র এটিকে আদর্শ বলেনি, বরং ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে জানিয়েছে।

সমকামিতা : শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি

অয়্যপ্পা বা ইলার কাহিনি অনেকে সমকামিতার উদাহরণ হিসেবে দেখালেও, শাস্ত্র এগুলো সমর্থন করে না।

মনুস্মৃতি বলছে—

“পুরুষের সঙ্গে পুরুষের মিলন জাতিভ্রংশের কারণ।” (মনুস্মৃতি ১১/৬৭)

নারী সমকামিতার ক্ষেত্রেও কঠোর শাস্তি বর্ণিত আছে। (মনুস্মৃতি ৮/৩৬৯-৩৭০)

অতএব, হিন্দু শাস্ত্রে সমকামিতা কোনোভাবেই অনুমোদিত নয়।

মূল উত্তর : নারী কেন একাধিক বিবাহ করতে পারে না?

পুরুষকে সীমিত বহুবিবাহের অনুমোদন দেওয়া হলেও, নারীর ক্ষেত্রে তা নিষিদ্ধ। এর প্রধান কারণ হলো—

  • সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ করা যাবে না।
  • পরিবার ও গোত্রের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
  • সমাজে উত্তরাধিকার ব্যবস্থা জটিল হয়ে যাবে।

অর্থাৎ পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করার জন্যই এই নিয়ম গড়ে ওঠে। তবে বিধবা পুনর্বিবাহকে বহু শাস্ত্রই সমর্থন করেছে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি : সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ

বর্তমান বিজ্ঞানে জানা গেছে, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে শুক্রাণু। মায়ের কোনো দোষ নেই। অথচ সমাজে এখনো মেয়েদের দোষ দেওয়া হয়।

কিন্তু মনুস্মৃতিতে বহু আগেই লেখা আছে—

“পুত্র জন্ম হয় পুং শুক্র থেকে, কন্যা জন্ম হয় স্ত্রী শুক্র থেকে।” (মনুস্মৃতি ৩/৪৯)

অতএব, শাস্ত্র প্রমাণ করে নারীর দায় নেই, দায় পুরুষের শুক্রাণুর গঠনেই নিহিত।

হিন্দু বিবাহব্যবস্থা অত্যন্ত সুসংহত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। এখানে নারী-পুরুষের দায়িত্ব ভিন্ন হলেও সম্মান সমান।

  • বিচ্ছেদ আছে, তবে শর্তসাপেক্ষ।
  • পুনর্বিবাহ আছে, তবে সতর্কভাবে।
  • বহুবিবাহ পুরুষের জন্য সীমিত হলেও সমাজে অপ্রশংসিত।
  • নারীর বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, মূলত সন্তানের পিতৃত্ব ও সমাজরক্ষার কারণে।

অতএব দেখা যায়, প্রাচীন ঋষি-মুনিরা যে নিয়ম তৈরি করেছিলেন তা সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্যই। এখনকার দিনে সেই মূল ভাবনা থেকে শিক্ষা নেওয়াই শ্রেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *