Jeetu Kamal Biography in Bengali বাংলা বিনোদন জগতের ইতিহাসে এমন কিছু নাম রয়েছে, যাদের পথচলা সাধারণ দর্শকের কাছে কেবল বিনোদনের গল্প নয়, বরং এক অদম্য সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। জীতু কামাল তাঁদেরই একজন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বপ্ন পূরণের জন্য কেবল প্রতিভা থাকলেই হয় না, সেই প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্যের প্রয়োজন।জীতুর গল্প শুনলেই বোঝা যায়, শিল্পী হওয়ার যাত্রা কখনও সহজ হয় না।
তিনি প্রথমে আলোর আড়ালে থেকে নাটকের পিছনের কাজ করেছেন—আবহসঙ্গীত, আলো ফেলা, মঞ্চ প্রস্তুত করা। সেখানে কোনও নামজাদা পরিচিতি ছিল না, কেবল নীরব পরিশ্রম। অনেকের কাছে হয়তো এই কাজ ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই ছিল তাঁর ভিত্তি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, বড় শিল্পী হতে হলে ছোট কাজের মূল্যও সমানভাবে স্বীকার করতে হবে।অভিনয়ের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম ছিল। বড় পরিচালক হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, জীবনের বাঁকে বাঁকে তাঁকে অভিনয়ের জগতে টেনে এনেছে ভাগ্য। তিনি কখনও এই সুযোগকে হেলাফেলা করেননি। ছোট ছোট চরিত্রে কাজ করেও তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন।
মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা আসতে সময় লাগে, কিন্তু তিনি জানতেন নিজের জেদ এবং পরিশ্রমের সামনে কোনও বাধাই টিকবে না।জীতুর শুরুর দিনগুলো ছিল সত্যিই কঠিন। প্রযোজকের দপ্তরের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও দেখা না পাওয়া, পরিচিত মুখ না হওয়ার কারণে কাজ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া—এসব অভিজ্ঞতা যেকোনও মানুষকে ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বরং এই প্রত্যাখ্যানকেই প্রেরণা করেছেন। নিজের দক্ষতাকে আরও শাণিত করেছেন। এটাই তাঁর ব্যক্তিত্বের বড় বৈশিষ্ট্য—প্রতিকূলতার কাছে হার না মানা।ছোটপর্দায় তাঁর সাফল্য বাংলা দর্শককে এক নতুন অভিনেতার স্বাদ দিয়েছিল।
ধারাবাহিকের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। তবে টেলিভিশনে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরেও কাজের সংখ্যা কমে যেত, যা যে কোনও শিল্পীর কাছে বড় মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। উপরন্তু, সামাজিক মাধ্যমে বারবার কটাক্ষ, সমালোচনা, এমনকি ট্রোল—এসবও তাঁকে থামাতে পারেনি। বরং তিনি নিজের উত্তর দিয়েছেন অভিনয়ের মাধ্যমেই। এটাই এক প্রকৃত শিল্পীর শক্তি।
‘অপরাজিত’ ছবির প্রসঙ্গ আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। সত্যজিৎ রায়ের মতো মহীরুহের চরিত্রে অভিনয় করা যে কতটা দায়িত্বের, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো তরুণ সত্যজিৎ চরিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো ছবিতেই তাঁকে দেখা গেল। আর এই চরিত্রের জন্য তিনি যা করেছেন, তা আজকের দিনে বিরল। দাঁতের সামান্য পার্থক্য মেটাতে চিকিৎসকের শরণ নেওয়া, মাসের পর মাস গৃহবন্দী থেকে প্রতিটি ভঙ্গি রপ্ত করা—এসব কেবল একজন শিল্পীর ভেতরে থাকা সত্যিকারের শ্রদ্ধা এবং আত্মনিবেদনের প্রমাণ।
আজকের দিনে যেখানে অনেকে শুধু পরিচিতির জোরে সুযোগ পান, সেখানে জীতুর মতো শিল্পীকে দেখতে হয়েছিল বছরের পর বছর অপেক্ষা। তবুও তাঁর এই অধ্যবসায় দেখিয়ে দেয়, প্রকৃত প্রতিভা যত দেরিতেই হোক না কেন, একদিন অবশ্যই প্রকাশিত হয়।‘অপরাজিত’ মুক্তির পর যে সাড়া মিলেছিল, তা শুধুমাত্র বাংলা নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অনুভূত হয়েছে। সমালোচকরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, তিনি সত্যজিৎ রায়কে যেন সত্যিই জীবন্ত করে তুলেছেন। এখানেই তাঁর প্রকৃত জয়। এরকম স্বীকৃতি পেতে যে মানসিক শক্তি লাগে, সেটি তাঁর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম থেকে এসেছে।
এছাড়াও, তিনি যেভাবে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে নিজেকে বদলে ফেলতে পারেন, সেটাই তাঁকে অনন্য করেছে। একদিকে ছবির মেঘদূত, অন্যদিকে জনপ্রিয় ধারাবাহিকের আর্য সিংহ রায়—এই রূপান্তরই দেখায় তাঁর অভিনয়ের বহুমুখিতা। দর্শকের মন জয় করার জন্য এটি অপরিহার্য।তবে সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অনেক যন্ত্রণা। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো আঘাতও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তবুও তিনি জীবনকে থামতে দেননি। মহাকালকে নিজের শক্তির উৎস মনে করে তিনি আবারও উঠে দাঁড়িয়েছেন। এটাই আসল লড়াই—নিজের দুঃখকে ভেঙে গিয়ে সামনে এগিয়ে চলা।
একজন শিল্পীর জীবন আসলে কেবল আলো ঝলমলে মঞ্চ নয়, এর পেছনে থাকে অনেক না পাওয়ার কষ্ট, উপেক্ষা, দুঃখ আর অদম্য ধৈর্য। জীতু কামালের যাত্রা সেই সত্যকেই সামনে নিয়ে আসে। তাঁর জীবনের বড় বার্তা হলো—অভিজ্ঞতা যদি সুযোগের অভাবে না হয়, তবে শিল্পী গড়ে উঠবে কীভাবে? এই প্রশ্ন আজও টলিউডের জন্য প্রাসঙ্গিক।আমরা যদি ভেবে দেখি, জীতুর পথচলা অনেক তরুণ শিল্পীর জন্য এক শিক্ষার মতো।
যারা আজ শুরু করছে, তাঁদের কাছে তাঁর গল্পটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। কারণ তিনি দেখিয়েছেন, ব্যর্থতা আসবেই, প্রত্যাখ্যান হবে, কিন্তু তাতে থেমে গেলে চলবে না। একদিন সেই সংগ্রামই সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।সবশেষে বলা যায়, জীতু কামাল শুধু একজন অভিনেতা নন, তিনি এক জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর অভিনয় আমাদের আনন্দ দেয়, কিন্তু তাঁর লড়াই আমাদের সাহস যোগায়।
আজ তিনি বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় মুখ, তবুও ভিতরে ভিতরে তিনি রয়ে গেছেন এক অনমনীয় যোদ্ধা। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অটল বিশ্বাস আর অধ্যবসায়ের কাছে কোনও বাধাই অজেয় নয়।