মহালয়া মানেই বাঙালির কাছে এক আবেগ, এক বিশেষ অনুভূতি। বছরের অন্য সব দিনের থেকে আলাদা হয়ে মহালয়ার সকাল যেন এক জাদুময় সময়। ঘুম ভাঙে ঢাকের আওয়াজে, বাতাস ভরে ওঠে চণ্ডীপাঠের ধ্বনিতে। সেই সঙ্গে ভোরবেলা টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে দেবী রূপে সাজানো জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চেহারা। জি বাংলার মহালয়া অনুষ্ঠান ‘জাগো মা জাগো দুর্গা’ ঠিক সেই আবেগকেই আরও গভীর করে তোলে।
এ বছরের আয়োজন নিয়ে দর্শকের মধ্যে কৌতূহল তুঙ্গে। কারা কোন চরিত্রে আসছেন, দুর্গা থেকে মহিষাসুর, শিব থেকে কালী— সবকিছুর প্রতিই সমান আগ্রহ। এইবার অনুষ্ঠান ঘিরে যত তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, তা নিয়ে কিছু ভাবনা শেয়ার করছি।
শ্বেতা ভট্টাচার্য দুর্গার ভূমিকায়: এক অন্যরকম দায়িত্ব Mahalaya 2025 zee bangla
শ্বেতাকে আমরা এর আগে বিভিন্ন ধারাবাহিকে দেখেছি—তিনি নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয়, সংবেদনশীল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু দুর্গার রূপে তাকে দেখতে পাওয়া এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। দেবী দুর্গা মানেই শক্তি, সাহস আর মহিমার প্রতীক। সেই চরিত্রে শ্বেতাকে মানানসই করে তোলা সহজ কাজ নয়।
তবে শ্বেতার অভিনয় দক্ষতা, তার পর্দার উপস্থিতি ও গাম্ভীর্য নিশ্চয়ই দর্শকদের মন জয় করবে। বিশেষ করে দুর্গার রূপে শ্বেতাকে দেখতে পাওয়া তার ক্যারিয়ারের জন্যও একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হতে চলেছে।
রণজয় বিষ্ণু শিবের ভূমিকায়: শক্তির পরিপূরক Mahalaya 2025 zee bangla
দেবী দুর্গার সঙ্গে শিবের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শিব মানেই ধ্যান, গভীরতা, আবার এক অন্যরকম শক্তির প্রতীক। রণজয়কে আমরা সম্প্রতি জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কোন গোপনে মন ভেসেছে’ -তে দেখেছি। তার পর্দার ব্যক্তিত্ব ও গম্ভীরতা শিবের চরিত্রে বেশ মানানসই হবে বলেই মনে হয়।
দর্শকের প্রত্যাশা থাকবে—শ্বেতা ও রণজয়ের যুগলবন্দীতে দেবী-দেবতার সেই মহিমা যেন বাস্তবের ছোঁয়া পায়।
রুবেল দাস মহিষাসুর রূপে: নতুন এক চ্যালেঞ্জ
রুবেলকে আমরা সাধারণত নায়ক চরিত্রে দেখেছি। তার রোম্যান্টিক বা নরম-সরম ইমেজের বাইরে বেরিয়ে এবার তাকে দেখা যাবে অসুর মহিষাসুরের ভূমিকায়।
এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মহিষাসুর মানেই শক্তিশালী, ভয়ঙ্কর এক প্রতিপক্ষ, যার সামনে দেবী দুর্গা দাঁড়িয়ে জয়ের ইতিহাস রচনা করেন। রুবেল কতটা তীব্রতা আনতে পারেন এই চরিত্রে, সেটাই এখন দেখার। তবে দর্শকের কৌতূহল ইতিমধ্যেই তুঙ্গে—‘দুর্গার বর হল অসুর!’ এই কনট্রাস্টই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
ইধিকা পাল: দেবী পার্বতী ও মহিষাসুরমর্দিনী
ইধিকা পাল সাম্প্রতিক সময়ে ছোটপর্দায় জনপ্রিয় এক মুখ। দর্শকরা তাকে নরম, সংবেদনশীল চরিত্রে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনী হিসেবে তাকে দেখা হবে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। দেবী পার্বতী থেকে মহিষাসুরমর্দিনী—এ যেন শক্তির এক অসাধারণ রূপান্তর।
তার অভিনয়ে যদি সেই তেজ, সেই দাপট ফুটে ওঠে, তবে দর্শকের মনে আলাদা ছাপ ফেলবে।
অন্বেষা হাজরা: দেবী জগদ্ধাত্রী
অন্বেষাকে আমরা ‘আনন্দী’ চরিত্রে সকলের প্রিয় মেয়েটি হিসেবেই দেখেছি। এবার তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীর ভূমিকায় আসছেন। দেবী জগদ্ধাত্রী মানেই রক্ষাকারী শক্তি, ধৈর্য ও স্থিরতার প্রতীক। অন্বেষার মিষ্টি মুখচ্ছবি আর দৃঢ় চোখের দৃষ্টি হয়তো এই চরিত্রকে আলাদা মাত্রা দেবে।
আরাত্রিকা মাইতি ও দিব্যাণী মণ্ডল: কৌশিকী ও ত্রিপুরাসুন্দরী
আরাত্রিকা মাইতি দেবী কৌশিকীর ভূমিকায় আসছেন। দেবী কৌশিকী মানেই মায়ের আরেক রূপ—যেখানে রূপসী নারীর মাঝে লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর শক্তি। অন্যদিকে দিব্যাণী মণ্ডল অর্থাৎ জনপ্রিয় ‘ফুলকি’ এবার ত্রিপুরাসুন্দরী রূপে দর্শকের সামনে হাজির হবেন। তার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে প্রভাতী অনুষ্ঠানকে রঙিন করে তুলবে।
ঈশানি চট্টোপাধ্যায়, তনিষ্কা তিওয়ারি ও মোহনা মাইতি: বৈচিত্র্যের ছোঁয়া
ঈশানি দেবী ভদ্রকালীর চরিত্রে আসছেন—এটি তার জন্য একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। শক্তি, রাগ আর মহিমার মিলনে ভদ্রকালী রূপ ফুটিয়ে তোলা কঠিন, তবে সঠিক উপস্থাপন দর্শকদের মুগ্ধ করবে।
তনিষ্কা দেবী গন্ধেশ্বরী রূপে আর মোহনা দেবী কালী রূপে যে আসছেন, তাতেই বোঝা যায় অনুষ্ঠানটি কেমন বহুমুখী ও তারকাখচিত হতে চলেছে।
দর্শকের প্রত্যাশা: কেন এত আগ্রহ?
প্রতি বছর মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা করে দর্শকরা অপেক্ষা করেন। এর মূল কারণ দুটি—
- ভক্তি ও আবেগ: দেবী দর্শনের প্রথম সোপান হিসেবে টিভির পর্দায় এই অনুষ্ঠান পুজোর আবহ শুরু করে।
- তারকাখচিত আয়োজন: জনপ্রিয় মুখদের দেবদেবীর সাজে দেখা এক অন্যরকম আনন্দ দেয়।
এইবারও শ্বেতা, রণজয়, রুবেল থেকে শুরু করে ইধিকা, অন্বেষা—সবাই একসঙ্গে দেবী-দেবতার রূপে হাজির হওয়ায় দর্শকের প্রত্যাশা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন
এই অনুষ্ঠান কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, এটি একধরনের সাংস্কৃতিক আচারও। আমাদের সমাজে নারীর শক্তি, সাহস আর মাতৃত্বকে দেবী রূপে দেখা হয়। দেবী দুর্গার লড়াই মহিষাসুরের বিরুদ্ধে আসলে ন্যায়ের লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
টিভি পর্দায় এই প্রতীকী উপস্থাপন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শক্তি, সাহস আর আত্মবিশ্বাসই সব সমস্যার সমাধান।
প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়া
প্রতি বছরই দেখা যায়—গ্রাফিক্স, ভিএফএক্স, মিউজিক, সেট ডিজাইনে নতুনত্ব আনার চেষ্টা থাকে। এই বছরও দর্শকের আশা—আরও ঝকঝকে, আরও আধুনিক উপস্থাপন হবে। দেবী ও অসুরের লড়াই কেবল গল্প নয়, এটি ভিজ্যুয়াল এক্সপেরিয়েন্সও বটে।
সমালোচনার জায়গা
তবে একটা প্রশ্ন বারবার ওঠে—এইসব অনুষ্ঠানে কি সত্যিই দেবী রূপের মহিমা ফুটে ওঠে, নাকি এটি নিছক গ্ল্যামারাইজড বিনোদন?
অনেকেই বলেন—অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দেবদেবীর সাজে এলে দর্শক বিভ্রান্ত হন, ভক্তির পরিবর্তে শোবিজের ছোঁয়া বেশি চোখে লাগে। আবার অন্যরা মনে করেন—আধুনিক সময়ে দেবদেবীর চরিত্রে তারকাদের অভিনয়ই মানুষকে কাছে টানে।
ভবিষ্যতের দিক
এই ধরনের অনুষ্ঠান আগামী দিনে আরও বড় আকারে আসবে বলেই মনে হয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচার, আন্তর্জাতিক দর্শকের জন্য সাবটাইটেল, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার—সবকিছু মিলিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠান আরও বৈশ্বিক হয়ে উঠতে পারে।
জি বাংলার এ বছরের মহালয়া অনুষ্ঠান “জাগো মা জাগো দুর্গা” নিঃসন্দেহে এক বড় আকর্ষণ হতে চলেছে। শ্বেতা দুর্গার ভূমিকায়, রণজয় শিব হিসেবে, রুবেল মহিষাসুর রূপে—সবাই মিলে এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা উপহার দেবেন দর্শকদের।
এই আয়োজন শুধু টিভির অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক সাংস্কৃতিক মুহূর্ত। ভোরবেলার শিউলি ঝরা সকাল, রেডিয়োর চণ্ডীপাঠের নস্টালজিয়া আর টিভি পর্দায় দেবী দর্শন—সব মিলে মহালয়া আমাদের চিরন্তন উৎসবের সূচনা।
আপনার কি মনে হয়? এইবারের দেবী সাজ সবচেয়ে মানাবে কার? শ্বেতার দুর্গা রূপ, না কি রুবেলের মহিষাসুর চমক দিয়ে দেবে দর্শককে?