মাইসোর শহরের নাম উচ্চারণ করলেই প্রথমেই ভেসে ওঠে রাজপ্রাসাদ, দাশেরা উৎসব, এবং চামুণ্ডি পাহাড়ের মহিমা। কিন্তু এই শহরের শিকড়ে রয়েছে এক পৌরাণিক দানব-রাজা—মহিষাসুর। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিতে মহিষাসুর চিহ্নিত খলনায়ক হিসেবে, যার বিরুদ্ধে দেবী দুর্গা লড়েছিলেন এবং শেষমেশ তাকে বধ করেছিলেন। কিন্তু মাইসোরে মহিষাসুর কেবল এক পৌরাণিক চরিত্র নন; তিনি স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও লোকবিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত।
এই শহরের প্রাচীন নামই ছিল “মহিষুরু”, অর্থাৎ মহিষাসুরের নগরী। সেই থেকে মাইসোরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আজও অমোঘ।
পৌরাণিক কাহিনি: মহিষাসুর ও দুর্গার সংঘর্ষ Mahishasura Facts
পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর ছিলেন অর্ধমানব অর্ধমহিষ রূপী এক অসুর। তিনি ব্রহ্মার কাছ থেকে এমন বরলাভ করেছিলেন, যাতে কোনো মানুষ বা দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না। সেই কারণে তিনি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং স্বর্গলোক ও পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি করেন।
দেবতাদের প্রার্থনায় তখন উদ্ভব হয়েন দুর্গা দেবী, যিনি নারীশক্তির প্রতীক। নয় রাতের ভয়ংকর যুদ্ধের পর চামুণ্ডি পাহাড়ে দুর্গা মহিষাসুরকে পরাস্ত করেন। এই ঘটনা থেকেই দুর্গাপূজা ও নবরাত্রির মূল কাহিনির সূচনা।
কিন্তু এখানেই থেমে যায় না গল্প। দক্ষিণ ভারতের মাটিতে এই কাহিনিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক অধ্যায়।
মাইসোরের নামকরণ ও ঐতিহাসিক যোগ
মাইসোর শহরের প্রাচীন নাম “মহিষুরু”—যার মানে মহিষাসুরের শহর। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনকালে এর ইংরেজি উচ্চারণে “Mysore” নামকরণ হয়। স্বাধীনতার পর আধুনিক উচ্চারণে “Mysuru” নাম আবার সরকারিভাবে চালু হয়।
এতে বোঝা যায়, মহিষাসুর কেবল পৌরাণিক খলনায়ক নন; তিনি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ভূগোলের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাঁর নামেই পরিচিত একটি সমৃদ্ধ জনপদ, যা আজ কর্ণাটকের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
চামুণ্ডি পাহাড়: যেখানে দেবী আর দানবের লড়াই
মাইসোর শহরের উপকণ্ঠে রয়েছে চামুণ্ডি পাহাড়। এখানেই দুর্গা দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন বলে বিশ্বাস। পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে উঠেছে বিখ্যাত চামুণ্ডেশ্বরী মন্দির। দেবীকে এখানে পূজা করা হয় মহিষমর্দিনী রূপে।
পাহাড়ের এক প্রান্তে আজও দেখা যায় বিশাল মহিষাসুরের মূর্তি। হাতে তলোয়ার আর সাপ, মাথায় টার্বান পরা এই রঙিন মূর্তি পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এটি শুধু ভক্তির প্রতীক নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক স্মারক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় শক্তি ও সাহসের চিরন্তন লড়াইয়ের কথা।
মাইসোর দাশেরা উৎসব ও মহিষাসুর
মাইসোর শহরের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো দাশেরা (Dasara), যা দুর্গাপূজারই অন্য রূপ। এখানে দশদিনব্যাপী জমকালো উৎসব হয়, রাজপ্রাসাদ আলোয় সাজানো হয়, এবং শোভাযাত্রা বের হয় শহরের রাস্তায়।
এই উৎসবের মূল বার্তা হলো—শুভ শক্তির দ্বারা অশুভ শক্তির বিনাশ। অর্থাৎ, দুর্গা দেবীর দ্বারা মহিষাসুরের বধ।
- হাতি সাজিয়ে বের হয় শোভাযাত্রা,
- দেবীর প্রতিমা পাহাড় থেকে আনা হয়,
- এবং মহিষাসুরের মূর্তির সামনে অর্পণ করা হয় ফুল-মালা।
মাইসোর দাশেরা উৎসব তাই শুধু ধর্মীয় আচার নয়; এটি মহিষাসুরের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে রাখে।
মহিষাসুর: খলনায়ক না নায়ক?
এখানেই উঠে আসে এক চমকপ্রদ দিক। কর্ণাটকের কিছু গবেষক ও সমাজবিদের মতে, মহিষাসুর আসলে ছিলেন স্থানীয় এক জনজাতি শাসক, যিনি নিজের জনগণের জন্য লড়াই করেছিলেন। তাঁর শক্তি ও প্রভাব এতটাই ছিল যে পরবর্তীকালে তাঁকে পৌরাণিক কাহিনিতে “অসুর” হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
আজও কর্ণাটকের কিছু সম্প্রদায় তাঁকে পূর্বপুরুষ ও নায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা জানায়। তাদের মতে, মহিষাসুর ছিলেন নিপীড়িত সমাজের রক্ষাকর্তা, যিনি শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
অতএব, মহিষাসুরের গল্প কেবল দেবী-দানবের লড়াই নয়—এটি ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজচেতনার মিশ্রণ।
মহিষাসুরের প্রতিমা: পর্যটনের বড় কেন্দ্র
চামুণ্ডি পাহাড়ের মহিষাসুর মূর্তি আজ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এই মূর্তি দেখতে। এর চারপাশে তৈরি হয়েছে নানা দোকান, ফুলের মালা, প্রসাদ ও স্মারক জিনিসের বাজার।
পর্যটকরা মূর্তির সামনে ছবি তোলে, আর স্থানীয়রা প্রার্থনা করে। এভাবে এই প্রতিমা একদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্র, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস।
সংস্কৃতির বহুমুখিতা ও মহিষাসুর
মাইসোরে মহিষাসুর এক সাংস্কৃতিক প্রতীক। তাঁর গল্পে যেমন রয়েছে অশুভ শক্তির বিনাশ, তেমনি রয়েছে স্থানীয় ইতিহাসের প্রতিফলন।
- পুরাণে তিনি খলনায়ক,
- লোককথায় তিনি নায়ক,
- আর ইতিহাসে তিনি এক রহস্যময় চরিত্র।
এই দ্বৈততা মাইসোর শহরকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। মহিষাসুর এখানে শুধুই এক পৌরাণিক কাহিনি নয়; তিনি শহরের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িত।
মাইসোরের মহিমা বোঝার জন্য মহিষাসুরকে বোঝা জরুরি। কারণ এই শহরের নাম, ইতিহাস, উৎসব ও পর্যটনের সঙ্গে তিনি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
মহিষাসুর হয়তো পুরাণে এক অসুর, যাকে দুর্গা দেবী বধ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস ও লোকচেতনায় তিনি অনেক বড় কিছু—তিনি এক যুগের প্রতীক, এক জনগোষ্ঠীর নেতা, এবং আজকের দিনে মাইসোরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ।
চামুণ্ডি পাহাড়ের মহিষাসুর প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে সেই দ্বৈততার সাক্ষী হয়ে—যেখানে দেবী আর দানবের যুদ্ধ কেবল ধর্মীয় কাহিনি নয়, বরং মানুষের জীবনের সংগ্রাম, সাহস আর অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি।