বাংলার টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি মানেই প্রতিদিনের নতুন মোড়, নতুন কাহিনি, নতুন উত্তেজনা। দর্শকরা বসে থাকেন কখন কী চমক আসবে—কার মৃত্যু, কার ফিরে আসা, কে কার প্রেমে পড়বে, কে আবার ষড়যন্ত্র করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই চমক দেওয়ার নেশাতেই অনেক সময় নির্মাতারা এমন গল্পের পুনরাবৃত্তি করেন যা দর্শকের মনে deja vu তৈরি করে। অর্থাৎ আগেও দেখা, আবারও দেখা।
‘ফুলকি’ ধারাবাহিকের সাম্প্রতিক পর্বে ঠিক এ রকমই একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে দর্শকদের। রোহিত চরিত্রের আকস্মিক মৃত্যু, তার হার্ট অন্য কাউকে দান, আর সেই ব্যক্তির অবিকল রোহিতের মতো চেহারা—সব মিলিয়ে নাটকীয় টুইস্ট। এই টুইস্টে অনেক দর্শক অবাক হলেও, অধিকাংশের মনে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠেছে অন্য এক সিরিয়ালের কথা—জি বাংলারই বহুল জনপ্রিয় ‘মিঠাই’।
কপি না কি কাকতালীয় মিল?
মিঠাই সিরিয়ালে আমরা দেখেছিলাম সিদ্ধার্থের মৃত্যুর পর তার নতুন রূপ—‘রিকি দ্যা রকস্টার’। প্রথমে সবাই হতবাক হলেও, ধীরে ধীরে দর্শকরা সেই গল্প মেনে নিয়েছিলেন। কারণ চরিত্রের জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। আবার মিঠাই-সিদ্ধার্থ জুটির মধ্যে দর্শকদের একটা আবেগী টান ছিল। ফলে নাটকীয় হলেও মানুষ সেটা গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু ফুলকির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। এখানে হুবহু একই কাহিনি প্রয়োগ হওয়ায় দর্শকরা প্রশ্ন তুলেছেন—“নতুনত্ব কোথায়?” অনেকেই লিখছেন, গল্পের মূল ধারা আগের মতো থাকলেও, নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা তো করা যেত! শুধু টিআরপি বাড়ানোর জন্য পুরনো সফল ফর্মুলা কপি করলে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য?
দর্শকের প্রতিক্রিয়া:
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দর্শকের ক্ষোভ চেপে থাকে না। কেউ লিখছেন,
- “টুকে টুকেই পাশ করছে ফুলকি।”
- “পুরোটা হুবহু মিঠাইয়ের গল্প।”
- “নতুন কিছু দেখানোর সাহস নেই নির্মাতাদের।”
আবার কেউ বলছেন, আসলে এটাকে “হোমেজ” বা “ট্রিবিউট” হিসেবেও দেখা যেতে পারে। হয়তো প্রযোজকরা মিঠাইয়ের জনপ্রিয় ট্র্যাককে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তবে অধিকাংশের মতে, যেহেতু দুটোই জি বাংলার সিরিয়াল, তাই এই রকম আত্মকপি একেবারেই মানায় না।
আবেগ বনাম যুক্তি
একদিক দিয়ে দেখা যায়, টেলিভিশন সিরিয়ালে আবেগই সব। দর্শকরা প্রতিদিন কাজের শেষে বসে থাকেন গল্পের নায়ক-নায়িকার সুখ-দুঃখ দেখার জন্য। সেখানে যুক্তির চেয়ে আবেগকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ফুলকির এই ট্র্যাকে আবেগের জোর যথেষ্ট। স্বামীকে হারানোর যন্ত্রণা, হঠাৎ করেই অবিকল চেহারার মানুষকে দেখা, তার গান গেয়ে মন জয় করার চেষ্টা—সবই দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করার মতো। তাই প্রথমে ক্ষোভ হলেও, অনেকেই হয়তো আবার নিয়মিত দেখতে থাকবেন।
কিন্তু অন্যদিকে, যে দর্শকরা ধারাবাহিক নিয়মিত দেখেন, তাদের স্মৃতি খুব তাজা। তাই তারা মিঠাইয়ের সঙ্গে তুলনা করবেই। ফলে যুক্তির বিচারে সমালোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক।
পুনরাবৃত্তির কারণ কী?
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বারবার এই পুনরাবৃত্তি?
১. টিআরপি চাপ: প্রতিযোগিতামূলক টেলিভিশন জগতে টিআরপি রেটিং ধরে রাখাই প্রধান লক্ষ্য। সফল ফর্মুলা কাজ করলেই সেটাকে বারবার ব্যবহার করা হয়।
২. সময়ের অভাব: প্রতিদিন নতুন এপিসোড বানাতে গিয়ে অনেক সময় লেখক ও প্রযোজকদের হাতে সৃজনশীলতা ঝালাই করার সময় থাকে না। ফলে সহজ পথে হাঁটতে হয়।
৩. দর্শকের অভ্যাস: নির্মাতাদের বিশ্বাস, দর্শক যাই হোক না কেন আবেগপ্রবণ গল্প পছন্দ করবে। তাই একই ট্র্যাকও বারবার চালানো যায়।
দর্শক-নির্মাতা সম্পর্ক
এখানেই আসল টানাপোড়েন। দর্শকরা চান নতুন কিছু, কিন্তু একইসঙ্গে তারা পুরনো পরিচিত ফর্মুলাতেও আবেগ খুঁজে পান। নির্মাতারা জানেন, যতই সমালোচনা হোক, এই বিতর্কই আসলে সিরিয়ালকে আলোচনার কেন্দ্রে রাখে। আর আলোচনার মানে বেশি ভিউয়ারশিপ।
ফুলকির বর্তমান পরিস্থিতিও তাই হয়েছে। সবাই সমালোচনা করলেও, সিরিয়ালটির নাম ঘুরে ঘুরে আসছে। অর্থাৎ প্রচার বাড়ছে। অনেকেই আবার কৌতূহল থেকে দেখতে শুরু করছেন।
সৃজনশীলতার সংকট না কি ব্যবসার কৌশল?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। একদিকে, এটা স্পষ্ট যে বাংলা ধারাবাহিকের জগতে নতুন চিন্তার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। একই ধাঁচের প্রেম, ষড়যন্ত্র, মৃত্যু, ফিরে আসা—এই চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে গল্প।
অন্যদিকে, ব্যবসার দিক থেকে এটা একধরনের কৌশল। কারণ প্রমাণিত রেসিপি ব্যবহার করলে ব্যর্থতার ঝুঁকি কম। দর্শক কাঁদবে, হাসবে, উত্তেজিত হবে—টিআরপি বাড়বে।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করতে পারে। কারণ বারবার একই জিনিস দেখলে দর্শক ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তখন হয়তো তারা ওটিটি বা অন্য বিনোদন মাধ্যমের দিকে ঝুঁকবে।
ফুলকির গল্পের সম্ভাবনা
যদিও বর্তমানে সমালোচনা হচ্ছে, তবুও ফুলকির গল্পে এখনো অনেক সম্ভাবনা আছে। যদি নির্মাতারা এই রোহিত-সদৃশ চরিত্রকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন, অন্যরকম টুইস্ট যোগ করেন, তাহলে হয়তো দর্শক আবার আগ্রহী হবে।
উদাহরণস্বরূপ, দেখা যেতে পারে—
- এই মানুষটা আদৌ রোহিত নয়, বরং অন্য কেউ।
- তার জীবনে লুকিয়ে আছে অন্য রহস্য।
- ফুলকির আবেগের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন সংগ্রাম।
এই সব মিলিয়ে গল্পকে অন্যদিকে ঘোরানো সম্ভব।
দর্শকের প্রত্যাশা
আজকের দর্শক অনেক বেশি সচেতন। তারা শুধু আবেগ নয়, যুক্তিও খোঁজে। তাই নির্মাতাদের উচিত দর্শকের এই প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেওয়া। শুধুমাত্র পুরনো সাফল্যের ছায়ায় নতুন সিরিয়াল চালালে সেটা হয়তো সাময়িকভাবে কাজ করবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে নয়।
সমালোচনার মধ্যেই সাফল্য?
শেষমেশ বলা যায়, বিতর্ক মানেই ব্যর্থতা নয়। বরং অনেক সময় বিতর্কই সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা বাড়ায়। এখন ফুলকির ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। সমালোচনা যত বাড়ছে, ততই সিরিয়ালটি আলোচনায় থাকছে।
তবে এটাও সত্যি যে, যদি নির্মাতারা নতুনত্ব না আনেন, তাহলে একসময় দর্শক বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যাবে।
বাংলা টেলিভিশনের সিরিয়াল জগৎ এক অদ্ভুত জায়গা। এখানে আবেগ আর বাস্তবতা, সৃজনশীলতা আর ব্যবসা, দর্শকের প্রত্যাশা আর নির্মাতাদের কৌশল—সব মিলিয়ে চলে টানাপোড়েন।
‘ফুলকি’র সাম্প্রতিক ট্র্যাক হয়তো অনেকের চোখে “মিঠাইয়ের কপি” মনে হচ্ছে, কিন্তু তবুও এটা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। প্রশ্ন উঠছে, বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, দর্শক রাগ করছে—কিন্তু একসঙ্গে কৌতূহলও বাড়ছে।
শেষ পর্যন্ত দর্শক আসলেই কী চান—অন্যরকম গল্প না কি পুরনো আবেগের পুনরাবৃত্তি? এই উত্তরই ভবিষ্যতে বাংলা ধারাবাহিকের দিকনির্দেশ ঠিক করবে।