পিতৃপক্ষ কী?
পিতৃপক্ষ (Pitripaksha) হলো হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ সময়কাল, যা মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ, তর্পণ ও পিণ্ডদান করার জন্য নির্দিষ্ট।সময়কাল: ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার পরের দিন থেকে আশ্বিন মাসের অমাবস্যা পর্যন্ত মোট ১৫ দিন (সাধারণত সেপ্টেম্বর–অক্টোবর)।
অর্থ: ‘পিতৃ’ মানে পূর্বপুরুষ, আর ‘পক্ষ’ মানে পাক্ষিক সময় বা ১৫ দিন।উদ্দেশ্য: বিশ্বাস করা হয়, এই সময়ে পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীতে এসে জীবিত বংশধরদের কাছ থেকে অন্ন, পিণ্ড ও তর্পণ গ্রহণ করেন।
শ্রাদ্ধের মূল কাজগুলো
1. পিণ্ডদান: সিদ্ধ চাল, তিল, দুধ, জল ইত্যাদি দিয়ে পিণ্ড তৈরি করে অর্ঘ্য।
2. তর্পণ: জল, কুশ ও তিল দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান।
3. ব্রাহ্মণ ভোজন ও দান।
4. কাক, কুকুর ও গরুকে অন্ন দেওয়া। (পূর্বপুরুষের প্রতীক রূপে)।
মৃত্যুর বহু বছর পরেও কী করা উচিত?
মৃত্যু যত বছর আগেই হোক না কেন, শ্রাদ্ধ সবসময় করা যায়।তিথি অনুযায়ী বা মহালয়া অমাবস্যায় শ্রাদ্ধ করলে আত্মা সন্তুষ্ট হন।বড় আয়োজন সম্ভব না হলেও অন্তত একদিন ব্রাহ্মণ/গরিবকে খাওয়ানো, অন্নদান বা তর্পণ করা অত্যন্ত শুভ।
মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় যায়?
হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে
1. মৃত্যুর পর আত্মা প্রথমে প্রেতলোকে অবস্থান করে।
2. তারপর যমরাজ কর্মফল বিচার করেন।3. কর্ম অনুযায়ী আত্মা স্বর্গ/নরক বা প্রেতলোকে কিছু সময় কাটায়।
4. এরপর পুনর্জন্ম গ্রহণ করে।
5. যদি মুক্তি পায়, তবে আর জন্ম নিতে হয় না—সে ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হয়।
পুনর্জন্ম হয়েছে কি না কিভাবে বোঝা যায়?
জন্ম নিয়েছে বুঝতে:
শিশুদের অচেনা স্মৃতি, আচরণ বা জ্ঞান।
জন্মদাগ (পূর্বজন্মের আঘাতের চিহ্ন)।
অকারণ টান বা ভয়।
জন্ম নেয়নি বুঝতে:
পূর্বপুরুষ স্বপ্নে দেখা দেন।
শ্রাদ্ধের সময় হাওয়া, গন্ধ বা বিশেষ শান্তির অনুভূতি হয়।
অভিজ্ঞ পুরোহিত/সাধকের মাধ্যমে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
আত্মা মুক্তি পেয়েছে কি না কিভাবে বোঝা যায়?
1. স্বপ্নে শান্তভাবে দেখা দেওয়া।
2. শ্রাদ্ধের সময় কাক, গরু, কুকুর সহজে অন্ন গ্রহণ।
3. পরিবারে অশান্তি না থাকা, বরং উন্নতি ও শান্তি থাকা।
4. পুজো বা ধ্যানে গভীর শান্তি অনুভব।
5. অভিজ্ঞ পুরোহিত বা সাধকের নির্দেশ।
যদি কোনও লক্ষণই বোঝা না যায়?
সব আত্মার ক্ষেত্রেই স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায় না। শাস্ত্র বলে— আন্তরিক ভক্তি নিয়ে শ্রাদ্ধ করলে আত্মা অবশ্যই শান্তি লাভ করেন।
ঘরে বসে সহজ শ্রাদ্ধ/প্রার্থনার পদ্ধতি প্রস্তুতি
ঘর পরিষ্কার করুন, আসনে বসুন।
প্রদীপ, জল, তিল, চাল, ফুল, গঙ্গাজল রাখুন।
ধাপসমূহ
1. প্রদীপ জ্বালিয়ে পূর্বপুরুষদের নাম করে স্মরণ।2. হাতে জল, তিল, চাল নিয়ে তিনবার অর্ঘ্য দিয়ে বলুন—“আমার পূর্বপুরুষদের আত্মা যেন শান্তি পান।”
3. ১১/২১ বার মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ।
4. সামান্য অন্ন কাক/কুকুর/গরুকে দিন, গরিবকে খাওয়ান।
5. শেষে প্রার্থনা করুন—“হে ঈশ্বর, আমার পূর্বপুরুষেরা যেন মুক্তি পান ও শান্তি লাভ করেন, এবং আমাদের আশীর্বাদ করেন।”—
বাংলা প্রার্থনা পাঠ“হে সর্বশক্তিমান ভগবান,আজ আমি আমার পূর্বপুরুষদের আত্মার জন্য এই অর্ঘ্য নিবেদন করছি।আমি জানি আত্মা অমর, আর তাঁদের আত্মা এখনও আমাদের সঙ্গে আছে।তাঁরা যেন সকল দুঃখ, কষ্ট ও বন্ধন থেকে মুক্তি পান।
যদি নতুন জন্ম নিয়ে থাকেন তবে তাঁদের জীবনে সুখ ও শান্তি আসুক।যদি মুক্তির পথে থাকেন তবে ঈশ্বরের চরণে আশ্রয় লাভ করুন।হে পূর্বপুরুষ, আমাদের সবসময় আশীর্বাদ করুন।ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।”
পিতৃপক্ষ হলো পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ সময়।মৃত্যু যত বছর আগেই হোক, শ্রাদ্ধ করলে আত্মা শান্তি পান।জন্ম হোক বা না হোক, অর্ঘ্য তাঁদের কাছে পৌঁছায়।লক্ষণ বোঝা কঠিন হলেও ভক্তি ও শ্রদ্ধাই আসল। তাই শ্রাদ্ধ, তর্পণ ও প্রার্থনা করে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করুন।