ভারতের রাজনীতির আকাশে অনেক তারকা জ্বলে উঠেছে, কিন্তু কিছু তারকার আলো এতটাই আলাদা যে মানুষ শুধু তাঁদের নামেই ভরসা খুঁজে পায়। আজ আমরা কথা বলব এমন একজন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে, যিনি শিক্ষার মঞ্চ থেকে রাজনীতির মঞ্চে উঠে এসে কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন—ড. সুধাংশু ত্রিবেদী। তিনি শুধু বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নন, তিনি একজন চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং ‘যুক্তির যোদ্ধা’। তাঁর জীবন, তাঁর কাজ এবং তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে আজকের এই ভিডিও।”
শৈশব ও শিক্ষা Sudhanshu Trivedi
“সুধাংশু ত্রিবেদীর জন্ম ২০ অক্টোবর ১৯৭০ সালে, উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্মীপুরে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বইপোকা। পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষা যেমন পেয়েছিলেন, তেমনি বিজ্ঞানের প্রতিও তাঁর গভীর কৌতূহল ছিল।
তিনি প্রথমে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন, পরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন, জ্ঞান অর্জন শুধু ক্যারিয়ারের জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে আলোর দিশা দেয়।
পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়েও গবেষণা চালিয়ে যান। তাঁর বইয়ের সংগ্রহে শুধু আধুনিক বিজ্ঞান নয়, বেদ, পুরাণ ও মহাকাব্যও সমানভাবে স্থান পেয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই এই ভারসাম্য তাঁকে করে তোলে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।”
শিক্ষকতা থেকে রাজনীতিতে যাত্রা
“শিক্ষাজীবন শেষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। একজন তরুণ অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু শিক্ষকতা করার সময়ই তিনি বুঝতে পারেন, দেশের জন্য তাঁর দায়িত্ব শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ধীরে ধীরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথমে তিনি ছিলেন রাজনাথ সিংয়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা। পরে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। এখান থেকেই তাঁর রাজনীতির ভিত মজবুত হতে শুরু করে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপির প্রচার ও যোগাযোগ টিমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখন থেকেই তাঁর সংগঠনিক ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতা প্রকাশ্যে আসে।”
জাতীয় মুখপাত্র হিসেবে উত্থান
“২০১৬ সালে তাঁকে বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকে শুরু তাঁর এক নতুন যাত্রা। সংবাদমাধ্যমের বিতর্কে তিনি সবসময় শান্ত স্বরে কথা বলেন, কিন্তু তাঁর প্রতিটি শব্দ যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি— ‘আমি বিতর্কে জিততে আসিনি, আমি আসি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে।’
এই একটি লাইনই তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে স্পষ্ট করে। তিনি জানেন, মানুষকে জেতানো যায় না চিৎকার করে, বরং জেতানো যায় সত্য ও তথ্য দিয়ে।
তাঁর বক্তৃতায় যেমন আধুনিক রাজনীতির বিশ্লেষণ থাকে, তেমনি থাকে ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা। এই ভারসাম্যই তাঁকে আলাদা করেছে অন্যান্য মুখপাত্রদের থেকে।”
সংসদ ও দায়িত্ব
“২০১৯ সালে তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি ডিফেন্স কমিটি, এনার্জি কমিটি, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটিতে কাজ করছেন।
এখানেও তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি কেবল বক্তা নন, বরং একজন সক্রিয় নীতি নির্ধারক। দেশের প্রতিরক্ষা, শক্তি নীতি এবং অর্থনৈতিক দায়িত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ক্রমেই বাড়ছে।”
বিতর্ক শৈলী ও জনপ্রিয়তা
“টেলিভিশনের বিতর্কে সুধাংশু ত্রিবেদীর আলাদা এক জায়গা রয়েছে। তিনি কখনো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কথা বলেন না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেন।
তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার এতটাই সমৃদ্ধ যে, ধর্ম থেকে প্রযুক্তি—যেকোনো বিষয়েই তিনি সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন। একদিকে তিনি শিবাজি মহারাজের ইতিহাস বিশ্লেষণ করেন, অন্যদিকে আধুনিক ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়েও মতামত দেন।
তাঁর এই বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে মুগ্ধ করে। এ কারণেই সোশ্যাল মিডিয়ায়ও তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক তরুণ তাঁকে ‘রোল মডেল’ হিসেবেও দেখেন।”
সাম্প্রতিক বক্তব্য ও জাতীয় চেতনা
“২০২৫ সালে নাগপুরে শিবাজি মহারাজের ৩৫১তম জন্মজয়ন্তীতে তিনি বলেন— ‘শিবাজি মহারাজ শুধু মহারাষ্ট্রের নন, তিনি গোটা দেশের সম্পদ।’
তিনি সমালোচনা করেন ব্রিটিশদের ইতিহাস রচনার, যেখানে শিবাজিকে কেবল আঞ্চলিক নেতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তাঁর মতে, শিবাজি ছিলেন একজন জাতীয় বীর, যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক।
এ ধরনের বক্তব্য প্রমাণ করে, সুধাংশু ত্রিবেদী রাজনীতির বাইরে গিয়ে জাতীয় চেতনা জাগাতে চান। তিনি ইতিহাসকে নতুনভাবে পড়তে ও বোঝাতে সক্ষম।”
ব্যক্তিগত জীবন Sudhanshu Trivedi
“২০০৯ সালে তিনি ড. শালিনী ত্রিবেদীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শালিনীজি একজন অর্থনীতিবিদ। তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে। ব্যস্ত রাজনৈতিক জীবনের মাঝেও তিনি পরিবারকে সময় দেন এবং সমাজসেবামূলক কাজে সক্রিয় থাকেন।
তাঁর জীবনের এই দিকটিও মানুষকে প্রেরণা দেয়—যেভাবে একজন মানুষ কর্মজীবন, পরিবার এবং সমাজ—এই তিন ক্ষেত্রেই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন।”
“ড. সুধাংশু ত্রিবেদীর জীবনকাহিনি শুধু একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি একটি দর্শনের প্রতিফলন।
আমরা প্রায়ই দেখি রাজনীতিবিদ মানেই চেয়ার ধরে রাখার লড়াই, ক্ষমতার খেলা। কিন্তু ত্রিবেদীজি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি মানে সমাজের সেবা, জ্ঞানের প্রচার এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা।
তাঁর চিন্তাভাবনার মূল ভিত্তি হলো ‘সনাতন দর্শন’। তিনি বিশ্বাস করেন, ভারতের শিকড় যতটা মজবুত হবে, আধুনিকতার ফল ততটাই মিষ্টি হবে। তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রাচীন জ্ঞান—দুটোকেই সমান গুরুত্ব দেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ আজ আমরা প্রায়ই দেখি তরুণেরা আধুনিকতা গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের শিকড় ভুলে যায়। ত্রিবেদীজি দেখিয়ে দিয়েছেন, শিকড় ধরে রেখে আধুনিকতা গ্রহণ করাই প্রকৃত অগ্রগতি।
আরেকটি দিক হলো তাঁর বক্তৃতা। আজকের দিনে রাজনীতি মানেই চিৎকার, হট্টগোল, প্রতিপক্ষকে অপমান করা। কিন্তু ত্রিবেদীজি দেখিয়েছেন, শান্ত স্বরে কথা বলেও মানুষের মন জেতা যায়। যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে হারানো যায়।
এটি এক প্রকার নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
আমাদের সমাজে প্রায়ই বলা হয়, রাজনীতি মানেই নোংরা খেলা। কিন্তু সুধাংশু ত্রিবেদীর জীবনকাহিনি প্রমাণ করে, রাজনীতি মানে যদি সৎ মানুষরা আসেন, তবে সেটি হতে পারে সেবার মঞ্চ। তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন বৃহত্তর সমাজকে শিক্ষিত করতে।
আমরা যদি একটু খেয়াল করি, তবে দেখব তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। সেখানে থাকে শিক্ষার উপাদান। ইতিহাসের তথ্য, সংস্কৃতির ব্যাখ্যা, আধুনিক সমাজের বিশ্লেষণ—সব মিলিয়ে তাঁর বক্তৃতা যেন একটি জীবন্ত ক্লাসরুম।
এই কারণেই তরুণেরা তাঁকে এত পছন্দ করেন।
সবশেষে বলা যায়, সুধাংশু ত্রিবেদী একজন ‘দর্শনশীল রাজনীতিবিদ’। তিনি কেবল ভোটের রাজনীতি করেন না। তিনি মানুষের হৃদয়ে যুক্তির আলো জ্বালাতে চান। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—
- জ্ঞানই আসল শক্তি
- সত্য প্রতিষ্ঠা করাই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য
- আর শিকড়কে ভুলে গেলে অগ্রগতি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আজকের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব আমাদের আশ্বাস দেয় যে এখনও কিছু মানুষ আছেন যারা রাজনীতিকে সমাজসেবার হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।”