গণেশ চতুর্থীর মাহাত্ম্য ganesh chaturthi 2025
প্রথমে আসি এর মাহাত্ম্যের কথায়।
আমরা জানি, শ্রীগণেশ হলেন মহাদেব ও দেবী পার্বতীর সন্তান। তাঁর রূপটাই আলাদা—হাতির মাথা, মানুষের দেহ। এক অদ্ভুত, তবুও মহাশক্তির প্রতীক এই রূপ।
পুরাণে বলা আছে, দেবী পার্বতী মাটি দিয়ে নিজের দেহরক্ষী তৈরি করেছিলেন, আর সেই থেকেই গণেশের জন্ম।
শিব যখন তাঁকে চিনতে পারেননি, তখন গোপালক গণেশকে শিরশ্ছেদ করেছিলেন। পরে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও দেবীর অনুরোধে শিব হাতির মাথা বসিয়ে পুনর্জীবন দেন। তখন থেকে গণেশ হলেন জ্ঞানের দেবতা, বিদ্যার দেবতা, আর সাথে সাথে বিঘ্নহর্তা।
তাই যে কোনো নতুন কাজ শুরু করার আগে গণেশকে স্মরণ করা হয়।
যেমন ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে গেলে আগে গণেশের নাম নেয়, ব্যবসায়ী নতুন দোকান খুললে আগে গাণেশ পূজা করে, এমনকি বিবাহ বা গৃহপ্রবেশের সময়ও গাণেশ বন্দনা করা হয়।
২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থীর তারিখ ও সময় ganesh chaturthi 2025
এবার আসি মূল বিষয়ে—২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থী কবে পালিত হবে।
📅 ২০২৫ সালে ২৭ আগস্ট, বুধবার পড়ছে গণেশ চতুর্থী।
এটি ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথি।
তিথির হিসাব করলে দেখা যায়—
- চতুর্থী তিথি শুরু হবে ২৬ আগস্ট দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে
- আর শেষ হবে ২৭ আগস্ট বিকাল ৩টা ৪৪ মিনিটে।
কিন্তু সব তিথি শুরু আর শেষের মধ্যে সবচেয়ে শুভ সময় হলো মধ্যাহ্নকাল।
কারণ শাস্ত্র বলছে, গণেশ পূজা মধ্যাহ্নে করলে তা সর্বাধিক ফলপ্রদ হয়।
তাহলে পূজার শ্রেষ্ঠ সময় কবে?
👉 ২৭ আগস্ট সকাল ১১টা ০৫ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ৪০ মিনিট—এই সময়টাই সর্বোত্তম।
এ সময়ে পূজা করলে গণেশজি ভক্তের সমস্ত মনোবাসনা পূর্ণ করেন বলে বিশ্বাস।
পূজার নিয়ম ও আচার ganesh chaturthi 2025
এখন প্রশ্ন আসে—গণেশ পূজা কীভাবে করতে হবে?
এটি অনেকের কাছেই জটিল মনে হয়। কিন্তু আসলে নিয়মগুলো সহজ, শুধু ভক্তি আর আন্তরিকতা চাই।
১️ সকালে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে। সাধারণত লাল বা হলুদ রঙের পোশাক শুভ মনে করা হয়।
২️ ঘরে বা মণ্ডপে একটি মঞ্চ তৈরি করুন। লাল কাপড় বিছিয়ে প্রতিমা বা ছবিকে সেই আসনে বসান।
৩️ গঙ্গাজল ছড়িয়ে জায়গাটিকে পবিত্র করুন।
৪️ এখন গাণেশজিকে ফুল, বেলপাতা, দুর্গা ঘাস, চন্দন, ধূপ-দীপ নিবেদন করুন।
৫️ গণেশের সবচেয়ে প্রিয় প্রসাদ হলো মোদক। তাই অবশ্যই মোদক, লাড্ডু বা নারকেলের মিষ্টি দিতে হবে।
৬️ এরপর জপ করুন “ওঁ গং গণপতয়ে নমঃ” মন্ত্র। এই মন্ত্রের ধ্বনি বিঘ্ন দূর করে।
৭️ পূজা শেষে আরতি করুন, ভজন গাইতে পারেন, এবং সবার মাঝে প্রসাদ বিতরণ করুন।
শাস্ত্র মতে, এই পূজায় ১৬টি ধাপ থাকে, যাকে বলে শোডশো উপচার। কিন্তু সাধারণভাবে ফুল, ধূপ, দীপ, প্রসাদ নিবেদন করলেই গাণেশজি তুষ্ট হন।
চাঁদ দেখা নিষেধ
গণেশ চতুর্থীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বিশেষ বিশ্বাস—এই দিনে চাঁদ দেখা উচিত নয়।
কেন?
পুরাণে কাহিনী আছে—একবার গণেশজি যখন ভোজন সেরে ফিরছিলেন, তখন চাঁদ তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
রাগে গণেশ চাঁদকে অভিশাপ দেন যে, চতুর্থীর দিনে যেই চাঁদ দেখবে, সে মিথ্যা অপবাদে অভিযুক্ত হবে।
তাই এই দিনে চাঁদ দেখা এড়িয়ে চলা হয়।
শাস্ত্র বলছে, ২০২৫ সালে ২৬ আগস্ট দুপুর থেকে ২৭ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত চাঁদ দেখা বর্জনীয়।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
গণেশ চতুর্থী শুধু ঘরের পূজা নয়, এটি এখন সামাজিক উৎসব।
বিশেষত মহারাষ্ট্রে এর জাঁকজমক অসাধারণ। মণ্ডপ সাজানো হয়, বিশাল প্রতিমা আনা হয়, কয়েকদিন ধরে ভক্তরা প্রতিমার সামনে প্রার্থনা, ভজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন।
লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক এই উৎসবকে গণমানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় গণেশ চতুর্থী হয়ে ওঠে একতার প্রতীক।
আজও মুম্বাই, পুনে বা নাগপুরে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ শোভাযাত্রা হয় প্রতিমা বিসর্জনের সময়।
বাংলাতেও ধীরে ধীরে এর প্রচলন বাড়ছে। বিশেষ করে কলকাতায় এখন অনেক ক্লাব বা পরিবার ধুমধাম করে গণেশ চতুর্থী পালন করে।
আধ্যাত্মিক ভাবনা
যদি আমরা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দেখি, গণেশ মানে হলো অন্তরের ভয় দূর করা।
তাঁর বড় মাথা—জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রতীক।
বড় কান—অন্যের কথা শোনার ক্ষমতা।
ছোট চোখ—মনোযোগের প্রতীক।
মোটা পেট—সহিষ্ণুতা ও সবকিছুকে ধারণ করার ক্ষমতা।
আর হাতির শুঁড়—যা শক্তিশালী, তবুও নমনীয়।
এই প্রতিটি রূপ আমাদের জীবনের শিক্ষা দেয়।
জীবনে বাধা আসবেই, কিন্তু গণেশ আমাদের শেখান কীভাবে সেই বাধা অতিক্রম করতে হয়।
২০২৫ সালের প্রাসঙ্গিকতা
২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থী বুধবারে পড়ছে। বুধবার আবার বুধ গ্রহের দিন।
শাস্ত্র মতে, বুধ হলো বুদ্ধি, বাণিজ্য ও কথোপকথনের গ্রহ।
তাই এ বছর যারা শিক্ষায়, ব্যবসায় বা নতুন উদ্যোগে সফলতা চান—তাদের জন্য এই গণেশ পূজা বিশেষ শুভ।
- ২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থী হবে ২৭ আগস্ট, বুধবার।
- পূজার শ্রেষ্ঠ সময় সকাল ১১টা ০৫ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ৪০ মিনিট।
- চাঁদ দেখা এড়িয়ে চলতে হবে।
- পূজার নিয়ম সহজ—স্নান, প্রতিমা স্থাপন, ফুল-ধূপ-দীপ-প্রসাদ, মন্ত্রজপ ও আরতি।
গণেশ চতুর্থী… নাম শুনলেই এক অদ্ভুত আনন্দের স্রোত মনে ভেসে ওঠে। কেমন যেন একটা নতুন শুরুর ইঙ্গিত, এক অন্যরকম আশ্বাস—সব বাধা দূর হবে, জীবনের পথ খুলে যাবে।
প্রতি বছর এই উৎসব আসে, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয় নতুন কিছু শুরু হচ্ছে।
গণেশ মানেই বিঘ্নহর্তা। তিনি শুধু দেবতা নন, তিনি আমাদের জীবনের প্রতীক। তাঁর বড় মাথা আমাদের মনে করায়—বড় করে ভাবতে হবে। তাঁর ছোট চোখ বলে দেয়—মনোযোগী হতে হবে। তাঁর বড় কান শেখায়—অন্যের কথা শোনো। আর তাঁর শুঁড়… শক্তিও আছে, আবার নমনীয়তাও আছে। জীবনেও তো তাই হওয়া দরকার—কঠিন পরিস্থিতিতে শক্ত, কিন্তু যেখানে দরকার সেখানে নরম।
২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থী আবারও সেই একই শিক্ষা নিয়ে আসবে। ভাদ্র মাসের চতুর্থী তিথি, ভক্তদের কাছে এক মহামূল্যবান দিন। এদিনে ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করা, পরিষ্কার পোশাক পরা, ঘর গঙ্গাজলে ছিটিয়ে পবিত্র করা—সবই যেন এক প্রতীক। আসল ব্যাপার হলো ভেতরটাকে পরিষ্কার করা। শুধু শরীর নয়, মনকেও গঙ্গাজলে স্নান করাতে হবে।
এই দিনে গাণেশ প্রতিমা বসানো হয়, ধূপ-দীপ জ্বলে, মিষ্টি নিবেদন করা হয়। কিন্তু ভাবলে দেখা যায়—এসব প্রতিমা আর মিষ্টির মধ্যে একটা গভীর দার্শনিক বার্তা লুকিয়ে আছে। মিষ্টি মানে জীবনের মাধুর্য। গণেশকে মোদক দেওয়া মানে আমরা চাই আমাদের জীবনও যেন মিষ্টি হয়ে উঠুক।
আরও একটা বিশ্বাস আছে—এই দিনে চাঁদ দেখা যাবে না। প্রথমে মনে হয়, এ আবার কেমন কুসংস্কার? কিন্তু এর পেছনেও এক শিক্ষা আছে। চাঁদ হাসাহাসি করেছিল গাণেশকে দেখে, আর তার ফলে এসেছে অপবাদ। মানে কী? মানে হলো—অন্যকে নিয়ে হাসলে, ঠাট্টা করলে, শেষে নিজেরই অমঙ্গল ডেকে আনা হয়। তাই ওই নিষেধ আসলে আমাদের অহংকার ও ব্যঙ্গের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা।
এ উৎসব শুধু ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মহারাষ্ট্রে দেখবেন কী দারুণ উৎসবের আমেজ! বিশাল মণ্ডপ, অসংখ্য মানুষ, একসঙ্গে গান, নাচ, প্রার্থনা। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়—এটা শুধু পূজা নয়, এটা সামাজিক একতার উৎসব। মানুষের মধ্যে দূরত্ব ভেঙে দেয় এই উৎসব। যিনি ধনী, যিনি গরিব—সকলেই একই ভক্তিতে হাত জোড় করে দাঁড়ায় গাণেশের সামনে।
ভাবতে অবাক লাগে—একটা প্রতিমা, একখণ্ড মাটি, কীভাবে মানুষকে এতটা জুড়ে রাখে! কিন্তু আসল শক্তি তো প্রতিমায় নয়, আসল শক্তি আমাদের বিশ্বাসে। ভক্তির শক্তি যে কত বড়, গণেশ চতুর্থী তারই প্রমাণ।
এখন যদি ২০২৫ সালের সময়ের কথা ভাবি—২৭ আগস্ট, বুধবার। বুধবার আবার বুধের দিন। বুধ মানে বুদ্ধি, বাণিজ্য, কথোপকথন। মানে এই দিনে পূজা করলে শিক্ষা, ব্যবসা আর যোগাযোগ—এই তিন জিনিসে উন্নতির সুযোগ তৈরি হয়। যেন মহাজাগতিক শক্তিও বলে দেয়—এটা নতুন কিছু শুরু করার সঠিক সময়।
পূজার নিয়ম অনেকেই জানেন। কিন্তু আমি মনে করি, আসল পূজা নিয়মে নয়, আসল পূজা আন্তরিকতায়। ফুল, ধূপ, মোদক এসব বাহ্যিক। ভেতরে যদি বিশ্বাস থাকে, তবে খালি হাতে দাঁড়ালেও গাণেশ তুষ্ট হবেন।
তবু প্রতীকগুলো দরকার—কারণ প্রতীক ছাড়া আমরা মানুষ বুঝতে পারি না। তাই প্রতিমা দরকার, প্রসাদ দরকার। কিন্তু সেগুলো কেবল বাহ্যিক অবলম্বন। আসল কথা হলো—আমাদের মন ভরে গণেশকে ডাকতে হবে।
চিন্তা করলে দেখা যায়, গণেশ মানে শুধু এক দেবতা নয়, গণেশ মানে জীবনের এক দর্শন।
👉 বাধা আসবেই, কিন্তু সেটা ভাঙার শক্তি আছে।
👉 অন্ধকার থাকবেই, কিন্তু আলো জ্বালানোর সাহস আছে।
👉 হাসাহাসি, অপবাদ আসবেই, কিন্তু মনোবল থাকলে সব জয় করা যায়।
এই শিক্ষা নিয়েই তো গণেশ চতুর্থী আমাদের সামনে আসে।
প্রতিমা বিসর্জনের সময় মানুষ চিৎকার করে বলে—“গণপতি বাপ্পা মোরিয়া, আগলে বর্ষী লওকরিয়া।” মানে কী? মানে এইবার বিদায়, কিন্তু আগামী বছর আবার এসো।
এ যেন জীবনেরই প্রতীক। সুখ থাকবে না সারাজীবন, দুঃখও থাকবে না সারাজীবন। সবই আসবে, যাবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে—আবারও নতুন সুযোগ আসবে, নতুন আলো আসবে।
যদি ভাবি, কেন গণেশকে প্রথমে পূজা করা হয়?
কারণ, শুরুটাই আসল। শুরু ভালো হলে পথও ভালো হয়। একটা ঘর যদি মজবুত ভিত্তির ওপর তৈরি হয়, তবে ঝড়-ঝাপটা কিছুই করতে পারে না। তেমনি জীবনের শুরুতেও যদি আমরা গণেশকে আহ্বান করি, তবে বাকিটা সহজ হয়।
২০২৫ সালের এই বিশেষ দিনে, আমরা শুধু প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করব না। আমরা ভাবব—আমাদের জীবনের বাধাগুলো কী? কোথায় কোথায় আমরা আটকে আছি? শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, সম্পর্ক—যেখানেই হোক না কেন। আর আমরা গণেশের কাছে বলব—হে বিঘ্নহর্তা, আমাদের পথটা পরিষ্কার করে দাও।
আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার। গণেশকে বলা হয় জ্ঞানের দেবতা। জ্ঞান মানে শুধু বইয়ের পড়া নয়। জ্ঞান মানে জীবনের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, অন্যকে বোঝার ক্ষমতা। তাই গণেশ পূজা মানে হলো জ্ঞানকে সম্মান করা।
এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা শিখি—
- বড় হতে হলে মন বড় করতে হবে।
- সফল হতে হলে বাধা ভাঙতে হবে।
- মানুষ হতে হলে অহংকার ভাঙতে হবে।
- আর শান্তি পেতে হলে ভক্তি আর বিশ্বাস রাখতে হবে।
বন্ধুরা, গণেশ চতুর্থী ২০২৫ শুধু একটা দিন নয়, এটা হলো এক শিক্ষা।
একটা বার্তা—জীবনের পথে যত বাধাই আসুক, বিশ্বাস নিয়ে এগোলে সেই বাধা দূর হবেই।
তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে আন্তরিক ভক্তি নিয়ে বলি—
জয় গাণপতি বাপ্পা মোরিয়া!
গণেশ চতুর্থী কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি হলো নতুন শুরু, নতুন আশার প্রতীক।
তাই আসুন, আমরা সকলে আন্তরিক ভক্তি দিয়ে গণেশজিকে আহ্বান করি এবং জীবনের সব বাধা দূর করি।
জয় গণপতি বাপ্পা মোরিয়া!